অনার্স-মাস্টার্স যেন সার্কাস, তরুণদের স্বপ্ন নিয়ে আর কত মশকরা?

রাজীব হাসান
রাজীব হাসান © টিডিসি সম্পাদিত

বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে যে কয়েকটি মশকরা করা হয়, তার একটি হলো মাস্টার্স ডিগ্রি। অনার্স শেষ করতে হয় চার বছর ধরে। সাধারণভাবে ধরা হয়, অনার্স করলেই একজন তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশের যোগ্য হবেন। অতিরিক্তভাবে মাস্টার্স করার কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেকে চাকরি না পাওয়ার হতাশা থেকে গণহারে মাস্টার্স করছেন। অথচ মাস্টার্সের মূল উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিল গবেষণা ও জ্ঞানচর্চা—যা এখন অনেক ক্ষেত্রেই হারিয়ে গেছে।

সবচেয়ে বড় মশকরা হলো বিসিএস পরীক্ষা। এখানে এমন সব উদ্ভট প্রশ্ন করা হয়, যার সঙ্গে ভবিষ্যৎ চাকরির কোনো সম্পর্ক নেই। প্রায় পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থী অংশ নেন, চাকরি পান মাত্র দুই হাজার। ফলে বিসিএস মূলত যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের জায়গা না হয়ে দাঁড়িয়েছে বাদ দেওয়ার যন্ত্র হিসেবে।

রাষ্ট্র এ ব্যবস্থা কেন করছে? মূলত নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে। এমন এক কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, যাতে তরুণরা নিজেদের ব্যর্থ মনে করে—রাষ্ট্রকে নয়। অথচ সরকারি চাকরির সংখ্যা দেশের মোট চাকরির মাত্র ৫ শতাংশ। তাহলে বাকি ৯৫ শতাংশ তরুণ কোথায় যাবে?

স্বাভাবিকভাবেই সবাই বিসিএস বা সরকারি উচ্চপদে যোগ্য নন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই বাকিদের জন্য রাষ্ট্র কী করছে? এর উত্তর হতাশাজনক। সরকার শুধু গণহারে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপন করছে, যেগুলোর শিক্ষার সঙ্গে চাকরির বাজারের কোনো বাস্তব যোগসূত্র নেই। আমাদের মধ্যবিত্ত মানসিকতাও এ ক্ষেত্রে দায়ী—যেভাবেই হোক একটা চাকরি পেতে হবে, বেতন ১৫ হাজার হলেও চলবে।

অনার্স-মাস্টার্স নামের এই শিক্ষাসার্কাসে বিপুল পরিমাণ টাকা ও শ্রম অপচয় হচ্ছে। এ নিয়ে গবেষণা হওয়া জরুরি। বরং রাষ্ট্রের উচিত ছিল উচ্চশিক্ষাকে বাছাই-নির্ভর ও কঠিন রাখা, যাতে শুধু যোগ্যরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে একজন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে হাজারবার ভাবে—এ বিনিয়োগ তার কাজে লাগবে কি না।

বাংলাদেশের প্রয়োজন তরুণদের মুখস্থ বিদ্যার ফাঁদে না ফেলে দক্ষতা অর্জনে উৎসাহিত করা। যেন চাকরি না পেলেও তারা নিজে কিছু করতে পারে বা দক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে যেতে পারে। যদিও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা এখনও অপ্রতুল।

সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, তরুণদের মাথা থেকে ‘অনার্স-মাস্টার্স করতেই হবে’ ধরনের বাধ্যতামূলক চিন্তা দূর করা। এখন বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম বয়সে। এটিই হলো পপুলেশন ডিভিডেন্ড। কিন্তু এর সুযোগ নিতে হলে আমাদের হাতে আছে মাত্র ১৫ বছর। এরপর শুরু হবে এইজিং বারডেন। আজকের ২৫ বছরের তরুণ তখন ৪০ পেরোবে, কিন্তু যদি দক্ষতা না থাকে, রাষ্ট্রের কাঁধে চাপবে বিরাট বোঝা।

তাই এখনই সময় শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর। তরুণদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগাতে না পারলে, আগামী প্রজন্মকে আমরা ব্যর্থতার দিকেই ঠেলে দেব।

রাজীব হাসান: কথাসাহিত্যিক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক