শিক্ষা সংস্কারে ছাত্রশিবিরের ৩০ প্রস্তাবনা

সংবাদ সম্মেলনে ৩০ দফা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন সংগঠনটির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম
সংবাদ সম্মেলনে ৩০ দফা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন সংগঠনটির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম © টিডিসি ফোটো

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে ‌‘শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক, যুগোপযোগী ও নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে পুনর্গঠনের জন্য পাঠ্যক্রম, শিক্ষানীতি, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, উচ্চশিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, দক্ষতা, মূল্যায়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং বিবিধ বিষয়কে সামনে রেখে ৩০ দফা সংস্কার প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছে সংগঠনটি। 

আজ বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) বিকেলে ৪টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য ও শিক্ষা সংস্কারে ৩০ দফা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন সংগঠনটির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। 

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘অভ্যুত্থানের এক বছর অতিক্রম করে আমরা দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছি। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে ফ্যাসিবাদী সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ, কল্যাণমুখী ও সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে পুনর্গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি বা ঘোষণা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি বরাবরের মতোই উপেক্ষিত হচ্ছে, যা হতাশাজনক।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির এক মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে। ছাত্রশিবির বিশ্বাস করে একটি আদর্শ জাতি গঠনে শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই ছাত্রশিবিরের মৌলিক পাঁচ দফা কর্মসূচির একটি অন্যতম দফা—ইসলামী শিক্ষা আন্দোলন ও ছাত্রসমস্যা। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯০ বছরের দীর্ঘ আজাদীর লড়াইয়ের বিজয় এসেছিল ১৯৪৭ সালে। এটি শুধু ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তিই নয়; বরং জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ও নাগরিকত্বের স্বীকৃতির সূচনা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর শাসকদের অদূরদর্শিতা, ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অবমূল্যায়ন এবং রাজনৈতিক বৈষম্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে গভীর বিভাজন সৃষ্টি করে ইতিহাসের নতুন ধারা- ৫২ থেকে ৭১। 

অবশেষে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি নতুন পতাকা ও স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েও এ জনপদের মানুষ স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ লাভ করতে পারেনি। বারবার ক্ষমতার পালাবদলেও মানুষের ভাগ্যের মৌলিক কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধে চরম অবক্ষয়, গণতান্ত্রিক কাঠামোর ধ্বংস এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে তোলে। প্রতিষ্ঠিত হয় একদলীয় শাসন, দমন-পীড়ন, গুম, দুর্নীতি, ভোটাধিকার হরণ এবং অর্থ পাচারের সংস্কৃতি। রাষ্ট্রব্যবস্থা ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করে—মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার নির্বাসিত হয়। এই শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান–৩৬ জুলাই, যা ‘জুলাই বিপ্লব' হিসেবে বাংলাদেশের নতুন জাতিরাষ্ট্র বিনির্মাণের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।’

জাহিদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া উচিত সমতাভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও সৃজনশীল। যা নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ, বিজ্ঞানমনস্ক ও কর্মদক্ষতা বিকশিত করবে। এ ছাড়া শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করে সকলের জন্য বিনা মূল্যে ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করাই হোক দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অপ্রতুল। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী একটি দেশের জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার ২ শতাংশের কম। এশিয়ার সিঙ্গাপুর জাতীয় বাজেটের প্রায় ১০ শতাংশ, মালয়েশিয়া ১৭-২০ শতাংশ, ভারত সরকারি ব্যয়ের ১৩-১৭ শতাংশ (জাতীয় বাজেটে প্রায় ২.৫%), এবং চীন ১০-১৩ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করে। এর তুলনায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে নানা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকলেও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ মাত্র প্রায় ১.৮–২ শতাংশ, যা অত্যন্ত কম এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। দেশের তরুণ ছাত্র ও যুবসমাজের প্রতিনিধিত্বকারী দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির বিভিন্ন সময়ে সিম্পোজিয়াম, সেমিনার ও বুকলেট প্রকাশের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাসমূহ তুলে ধরেছে। বারবার স্মরণ করিয়েছে দিশেহারা একটি জাতির গঠনমূলক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি কী, কেন ও কেমন হওয়া জরুরি।’

শিবির সভাপতি বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী মানুষের চাহিদা, আশা- আকাঙ্ক্ষা ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের তাগিদে ৩০ দফা সংস্কার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছে। ছাত্রশিবির আশা করে, এই ৩০ দফা সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হলে শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি দূর হবে; যা সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরিতে ভূমিকা রাখবে, ইনশাআল্লাহ।’

ছাত্রশিবিরের ৩০ দফা প্রস্তাবনাগুলো হলো- অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কমিশন গঠন; জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তকরণ; ইসলামী মূল্যবোধ ও নৈতিকতা-সমন্বিত আধুনিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন; বহুমাত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষায় (STEM) অগ্রাধিকার প্রদান, ভাষা শিক্ষা সংস্কার; সামরিক ও শারীরিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ; শিক্ষা বাজেট অগ্রাধিকার; শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক স্কুলিং পদক্ষেপ; উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন; স্বাধীন ও স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন প্রণয়ন; নারী শিক্ষার প্রসারে উপর্যুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ; শিক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; শিক্ষার্থীদের জন্য শতভাগ আবাসন নিশ্চিত ও ব্যবস্থাপনায় আধুনিকীকরণ এবং  মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও কাউন্সেলিং ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।

এছাড়া শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাঙ্গন বাস্তবায়ন; যোগ্য ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ গঠন; গবেষণামুখী উচ্চশিক্ষা; মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সংক্রান্ত; কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধি; মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার; শিক্ষক প্রশিক্ষণ কাঠামোর আধুনিকায়ন; শিক্ষক মূল্যায়নের কার্যকর পদ্ধতি প্রবর্তন; চাকরিতে সমান সুযোগ ও ন্যায়ভিত্তিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ; ছাত্ররাজনীতির যথাযথ চর্চা ও নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন বাধ্যতামূলক আয়োজন করতে; কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বেকারত্ব হ্রাস; উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার উন্নয়ন ও সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবক-অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ।