দুর্নীতি-অনিয়ম
হিট প্রকল্প নিয়ে এক ডজন অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জমা দিলেন ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাছে
- টিডিসি রিপোর্ট
- ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৭:১২
দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে এবং ইউজিসির (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন) উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন ৪ হাজার কোটি টাকার হায়ার এডুকেশন অ্যাকসেলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (হিট) গবেষণা প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্নীতিকরণ, রাজনীতিকরণ এবং স্বজনপ্রীতকরনের অভিযোগ তুলেছেন সরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক। সোমবার (১১ আগস্ট) ইউজিসি কার্যালয়ে গিয়ে এ নিয়ে এক ডজন লিখিত অভিযোগ কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজের কাছে জমা দেন তারা। কমিশনের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানও উপস্থিত ছিলেন। এসময় চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন।
সাক্ষাৎকালে শিক্ষকরা ৪টি দাবি জানান। তাদের দাবিসমূহের মধ্যে রয়েছে: চলমান ১ম ধাপের প্রকল্পসমূহ চূড়ান্ত না করে এখনই স্থগিত করা; একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে হিট প্রকল্পের মূল্যায়নে ঘটে যাওয়া অনিয়মসমূহ খতিয়ে দেখা এবং নিরপেক্ষ রিভিউয়ারদের মাধ্যমে ব্লাইন্ড রিভিউ সম্পন্ন করা। প্রয়োজনে বহির্বিশ্বের এক্সপার্টদের সহযোগিতা নেয়া; জুলাই বিপ্লবের পরও যারা হিট প্রজেক্ট মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতিকরণ, রাজনীতিকরণ, এবং স্বজনপ্রীতিকরণের মাধ্যমে ইউজিসিকে কলঙ্কিত করেছে, তাদের দ্রুত অপসরণ করে যোগ্য লোকদেরকে দায়িত্ব প্রদান করা; এছাড়াও দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা; হিট প্রজেক্ট এর একটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে এর ‘রিচার্স প্রপোজাল ফরম্যাট’ যেখানে বিস্তারিত রিসার্চ মেথডোলজি লিখার বা রিভিউ করবার সুযোগ নেই। ডিটেল মেথডোলজি না থাকায়যারা প্রজেক্ট পেয়েছে তারা চাইলে অনেক টাকা নয়-ছয়করতে পারবে। এমন ফরম্যাট বাতিল করে ‘স্ট্যান্ডার্ড রিচার্স প্রপোজাল রাইটিং ফরম্যাট’ তৈরি করা করা হোক।
এসময় শিক্ষকদের কমিশন কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের পর্যবেক্ষণ ও দাবি দাওয়া যাচাই-বাছাই করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। ইউজিসি কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রস্তাবিত গবেষণা উপ-প্রকল্পগুলো প্রাতিষ্ঠানিক প্রকল্প, ব্যক্তিগত কোনো প্রকল্প নয়। সেজন্য স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের পর্যবেক্ষণ ও দাবি-দাওয়া ইউজিসি’র কাছে পেশ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সভায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সালেকুল ইসলাম, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম ও প্রফেসর ড. মো. সাইফুল ইসলাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. গোলাম মাওলাসহ হিট প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বলছেন, হিট প্রকল্পের আওতায় গবেষণা প্রকল্প প্রস্তাব মূল্যায়ন ও নির্বাচনের (ফেইজ ১) পুরো প্রক্রিয়াটি একগুচ্ছ অনিয়ম, বৈষম্য, রাজনৈতিক পক্ষপাত এবং অস্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে, যা আমাদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ এবং অনাস্থা সৃষ্টি করেছে। এই প্রকল্প, যা জনগণের ঋণের টাকায় পরিচালিত, তা এখন বিতর্ক ও বৈধতার সংকটে পড়েছে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হল উচ্চশিক্ষায়গুণগত পরিবর্তন, গবেষণাকে উৎসাহিত করা এবং দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং বাড়ানো। কিন্তু সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অস্বচ্ছতা, বৈষম্য এবং একাধিক অনিয়মে পরিপূর্ণ ছিল।
এক ডজন অভিযোগ, কী কী রয়েছে
রিভিউ প্রক্রিয়ার গুণগত মান ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব
প্রকল্প প্রস্তাবনাসমূহ এবং প্রেজেন্টেশন মূল্যায়ন বোর্ডে কারা রিভিউ ছিলেন, তারা কীভাবে মনোনীত হয়েছেন, এবং তাদের যোগ্যতা কী—এসব তথ্য গোপন রাখা হয়েছে। এটা এক গভীর ষড়যন্ত্র ও অনিয়মের ইঙ্গিত দেয়। আমরা জানতে পেরেছি যে, রিভিউ প্যানেলে এমন ব্যক্তিরাও ছিলেন যাদের পিএইচডি ডিগ্রি নেই, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তেমন কোনো গবেষণায় জড়িত নন যা আন্তর্জাতিক পর্যালোচনার ন্যূনতম মানদণ্ড। অনেক ক্ষেত্রে একই বিভাগের শিক্ষকরা নিজ বিভাগের সহকর্মীদের প্রকল্প প্রস্তাবনা রিভিউ করেছেন, আবার যাদের নিজেদের হিট প্রকল্প জমা ছিল, তাদের অনেকেই রিভিউয়ার ছিলেন যা স্পষ্টভাবে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, এ পদ্ধতি প্রকল্প মূল্যায়নের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
প্রকল্প রিভিউ পদ্ধতিতে বিশেষজ্ঞের কোনো মন্তব্য (review comments) বা পরিমার্জনের জন্য পরামর্শ (suggestions for revisions) লিপিবদ্ধ করার সুযোগ রাখা হয়নি—যা যেকোনো প্রকল্প রিভিউয়ের জন্য অত্যাবশ্যক। কোনো প্রকল্প কেন বাতিল বা ফান্ডিং-এর জন্য সুপারিশ করা হলো, সে বিষয়ে রিভিউয়ারের পরিষ্কার মন্তব্য উল্লেখ থাকা দরকার ছিল।
ব্লাইন্ড পিয়ার রিভিউ-এর দাবি মিথ্যা
ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেছেন, “প্রকল্পগুলো মূল্যায়ন করা হয়েছে ব্লাইন্ড রিভিউয়ের মাধ্যমে”। বাস্তবে এটি কোনোভাবেই “ব্লাইন্ড” রিভিউ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি রিভিউয়ার জানতেন তিনি কার/কাদের (i.e., Authors/Sub-Project Managers) প্রকল্প মূল্যায়ন করছেন। কারণ প্রতিটি আবেদনের সাথে আবেদনকারীদের বায়োডাটা এবং গবেষণা পেপারগুলোর তথ্য যুক্ত ছিল। অতএব, প্রফেসর ড. তানজীমউদ্দিনের দাবি কোনোভাবেই সত্য প্রমাণের সুযোগ নেই এবং সম্ভবও নয়। রিভিউয়ারগণ কোন প্রকল্পে কত নম্বর দিয়েছেন এবং মূল্যায়ন রিপোর্টে কী মন্তব্য করেছেন তা প্রকাশ করা হয়নি, যা প্রকল্প নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
প্রেজেন্টেশন মূল্যায়ন প্রসঙ্গে
ATF উপ-প্রকল্পের Window 3 sub-projects (Operation manual_ATF_UGC; 4.6.11)-এর জন্য প্রেজেন্টেশনের কথা বলা হলেও, অন্যান্য উইন্ডোগুলোতে (Window 1 ইত্যাদি) প্রেজেন্টেশন নেওয়া হয়েছে, যা নিয়মের পরিপন্থী। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে প্রেজেন্টেশন নেওয়া বা এর উপর মার্কিং করার কোনো কথা উল্লেখ ছিল না। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, প্রেজেন্টেশন মূল্যায়ন বোর্ডে এমন অনেক বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন যারা উপস্থাপিত গবেষণা প্রকল্পগুলো সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখেন না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প শুধুমাত্র প্রেজেন্টেশনের মূল্যায়নের ভিত্তিতে বাদ দেওয়া হয়েছে, যেখানে বিশেষজ্ঞরা প্রাসঙ্গিক নয় এমন প্রশ্ন করে বিভ্রান্ত এবং বিব্রত করেছেন।
উদাহরণ: Window 1 এ প্রেজেন্টেশান নিয়ে অনেক প্রকল্প বাতিল করেছে। সাবজেক্ট এক্সপার্ট না থাকার কারণে পেনডেমিক ক্লাস্টারের মধ্যে পরে না এমন প্রকল্প নির্বাচিত হয়েছে।
AHSS প্রকল্পগুলোর প্রেজেন্টেশনে ছিলেন প্রফেসর ড. গীতি আরা নাসরিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক, প্রফেসর ড. আইনুন নাহার ও প্রফেসর ড. মির্জা তাসলিমা সুলতানা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের। এদের মধ্যে দুজন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের, আরেকজন সাংবাদিকতা বিভাগের। অথচ তাদের সেশনে ইকোনমিকস, হিসাববিজ্ঞান, ইংরেজি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, দাওয়াহ ও ইসলামিক স্টাডিজ, প্রত্নতত্ত্ব, শিক্ষা বিজ্ঞান এমনকি আর্কিটেকচারের গবেষণা প্রকল্প প্রস্তাবনা উপস্থাপন ও মূল্যায়ন করা হয়েছে, যা হাস্যকর।
অঘোষিত বিভাগভিত্তিক বৈষম্য
একই বিভাগের একাধিক প্রকল্প প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হলেও একটিকে অনুমোদন ও অন্যগুলোকে অকারণেই বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ আবেদনকারীদের এই নীতির বিষয়ে আগে কিছুই জানানো হয়নি। এখানে রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতি প্রাধান্য পেয়েছে বলে আমরা মনে করি। উদাহরণ —যেখানে একই বিভাগ থেকে দুইটা প্রজেক্ট শর্টলিস্টেড ছিল, সেখানেই ফ্যাসিস্ট পন্থীদের প্রজেক্ট চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছে কিন্তু জুলাই বিপ্লবীদেরকে বাদ দিয়েছে।
উদাহরণ — রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও শাবিপ্রবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং জৈবপ্রযুক্তি বিভাগ এবং ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবপ্রযুক্তি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ইত্যাদি। আবার একই বিভাগ থেকে একাধিক প্রকল্প নির্বাচিত হয়েছে যেখানে সবাই ফ্যাসিস্টের এর অনুসারী, যেমন শাবিপ্রবির বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান এ দুইটা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে তিনটা প্রকল্প নির্বাচিত হয়েছে!
রিসার্চ কোয়ালিটির নামে বিভ্রান্তি এবং অনেক রিসার্চ ফিল্ডের প্রতি অবহেলা
অনেক নিম্ন-প্রোফাইলের গবেষক, যাদের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রকাশনা নেই, তারা প্রকল্প পেয়েছেন। অথচ অভিজ্ঞ গবেষকরা বাদ পড়ে গেছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে আন্তর্জাতিক মানের পিএইচডি না থাকলে গবেষণায় অনুদান দেয়া হয় না। অথচ এখানে পিএইচডিবিহীন গবেষক এবং রিভিউয়ার উভয়কেই মনোনীত করা হয়েছে, যাদের কারো কারো কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা/ প্রকাশনা নেই।
উদাহরণ — মো. সাদ্দাম হোসাইন, অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিএইচডি নেই! অন্যদিকে গবেষণা-বান্ধব অনেক রিসার্চ ফিল্ডের প্রতি অবজ্ঞা করা হয়েছে। যেমন দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাবিপ্রবি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, এবং বুয়েট— এর রসায়ন বিভাগের কোনো প্রকল্প অনুমোদিত হয়নি।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের বিভাগের যে সকল শিক্ষকেরা আবেদন করেছিলেন তাদের মধ্যে অনেকের ISI publication সংখ্যা ১০০ এর উপরে, সাইটেশন ৩০০০ এর উপরে, এবং তাদের কেউ কেউ ৩-৪ বার TWAS project (UNESCO) পেয়েছেন যেখানে অন্তত ৪০টি দেশের গবেষকদের সাথে প্রতিযোগিতা করে প্রকল্প জিততে হয়। আবার বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করা গেছে যে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে এমন একজনের প্রকল্প চুড়ান্তভাবে ফান্ডের জন্যে বাছাই করা হয়েছে যে প্রকল্পের কাজ সাধারণ রুটিন ওয়ার্ক মাত্র। এই প্রকল্পের SPM পিএইচডিতে অনুরূপ কোনো কাজ করেননি বা বর্তমানে তিনি প্রস্তাবিত প্রকল্পের অনুরূপ কোনো গবেষণার সাথে জড়িত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উক্ত SPM (ড. হালিমা বেগম, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়) এর গবেষণা প্রোফাইল (গুগল স্কলার অনুসারে মোট জার্নাল পাবলিকেশন ৬টি, মোট মাইটেশন ৩১, এইচ-ইনডেক্স ৩, আই১০ ইনডেক্স ২) থেকে বোঝা যায় তিনি বর্তমানে কোনোভাবে মানসম্পন্ন গবেষণার সাথে জড়িত নন।
এরকম উদাহরণ আরও আছে। এর একটি উদাহরণ হলো (শাবিপ্রবি), একজন নতুন গবেষককে (ড. মনির হোসেন, খাদ্য প্রকৌশল ও চা প্রযুক্তি) ১০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প দেয়া হচ্ছে, যার ইতিপূর্ব অভিজ্ঞতা গবেষণা প্রকল্প পাওয়া বা সফলভাবে সম্পন্ন করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই! ১০ কোটি টাকার হিট প্রকল্প হবে তাঁর প্রথম গবেষণা প্রকল্প! এটা নিশ্চিতভাবে দেশের জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের অপচয়। এখানে রাজনৈতিক সংস্লিষ্টতাই মুখ্য বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বা বিভাগভিত্তিক প্রকল্প সংখ্যা ও অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য
সামগ্রিকভাবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়থেকে কোনো প্রকল্পই গ্রহণ করা হয়নি, আবার কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলকভাবে অতি কম সংখ্যক প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে, যার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। উদাহরণস্বরূপ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো প্রকল্প অনুমোদিত হয়নি যদিও সেখানে যথেষ্ট ভালো মানের গবেষক রয়েছে। অন্যদিকে অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়যেগুলো বিভিন্ন সময় ইউজিসি কর্তৃক নজরদারিতে এসেছিল এবং সক্ষমতার প্রশ্ন উঠেছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বেশ কিছু প্রজেক্ট দেওয়া হয়েছে যেগুলো ফলপ্রসূভাবে সম্পন্ন হবে কি না সন্দেহ রয়েছে।
করোনা মহামারিকালে জাতীয়অবদান থাকা সত্ত্বেও প্রকল্প বাতিল
করোনা মহামারির সময়শাবিপ্রবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগ জাতীয়পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য রক্ষায়অনন্য ভূমিকা রেখেছে। বিভাগের উদ্যোগে সিলেট বিভাগে প্রথম কোভিড-১৯ আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার স্থাপন, স্বেচ্ছাশ্রমে হাজার হাজার নমুনা পরীক্ষা, হাসপাতালসমূহে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে সক্রিয়অবদান—এসব জাতীয়ও স্থানীয়পত্রিকাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এ বিভাগের গবেষকরা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণাও পরিচালনা করেছেন। অথচ এই অভিজ্ঞতা ও প্রাসঙ্গিকতা থাকা সত্ত্বেও, মহামারি সংক্রান্ত গবেষণা প্রকল্পটি হিটে প্রাথমিকভাবে মনোনীত হলেও নিয়ম বহির্ভূত প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ যাদেরকে এই ক্লাস্টারে ফান্ডিং করা হয়েছে তাদের কোভিড-১৯ বা একই রকম মহামারি প্রতিরোধের সামান্য অবদানও নেই। এটি এক চরম বৈষম্য এবং অবজ্ঞার নিদর্শন, যা প্রকৃত অবদানকে উপেক্ষা করার নামান্তর।
নৈতিক ও আদর্শগত সংকট
বিশ্বব্যাংকের পূর্বের প্রকল্প চলমান থাকা অবস্থায় একই প্রকল্প সামান্যভাবে পরিবর্তন করে পুনরায়জমা দিয়ে অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়েছে। এটি নৈতিক ও গবেষণা নীতির পরিপন্থী। অধ্যাপক ড. গোকুল চন্দ্র বিশ্বাস (এসপিএম) এর একটি প্রকল্প চলমান (Title: Acrylic Microfluidic Device with Laser Engraving for Low-Cost, Rapid, Colorimetric, and Multi-Antimicrobial Susceptibility Testing) যা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এর যৌথ ফান্ডিংয়ে পরিচালিত। এবার প্রায় একই শিরোনামে একটু ঘুরিয়ে-পেচিয়ে হিট প্রকল্প পাচ্ছেন! আমরা এখানে তাঁর সঙ্গে প্রফেসর ড. মোজাহার আলীর পরিচয়এবং রাজনৈতিক মতাদর্শকেই প্রকল্প পাওয়ার কারণ মনে করছি। অথচ ঐ একই বিভাগ থেকে মহামারির উপর আর একটা প্রকল্প ভিন্ন window এ শর্টলিস্টেড ছিল, সেটা কেন সিলেক্টেড হয়নি তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এটা নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি রাখে।
শুধু তাই নয়, আমাদের কাছে যা তথ্য আছে তা হলো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়থেকে যারা প্রকল্প জমা দিয়েছিলেন এবং যারা প্রফেসর ড. মোজাহার আলীর সাথে সুসম্পর্ক রেখেছেন, তাদের অনেকেই প্রকল্প পেয়েছেন। যেমনটি ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ড. জাহাঙ্গীর আলমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনিও রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে প্রফেসর ড. মোজাহার আলীর সুপরিচিত! ইসলামিক ইউনিভার্সিটির একই বিভাগের আর একটি প্রকল্প শর্টলিস্টেড হয়েছিল, সেটা কেন বাদ পড়েছে তা জানা যায়নি। আর যারা বাদ পড়েছেন তারা সবাই 'জুলাই বিপ্লবের' সঙ্গী ।
প্রকল্প জমাদানের সময় বর্ধিত করে অনৈতিক সুযোগ প্রদান
অনলাইনে প্রজেক্ট সাবমিশনের ডেডলাইন ছিল গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত। কিন্তু ঐদিন মধ্যরাতে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই প্রকল্প জমাদানের সর্বশেষ সময় ১১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১.৫৯টা পর্যন্ত এক্সটেনশন করা হয়েছিল। এটা কেন এবং কাদের স্বার্থে বর্ধিত করা হয়েছিল সেটি নিরপেক্ষ অনুসন্ধান দাবি রাখে। যারা পূর্বঘোষিত প্রকল্প জমাদানের সর্বশেষ সময় মেনে প্রকল্প জমা দিয়েছেন তারা ১২ ঘণ্টা সময়কম পেয়েছেন, যা সুস্পষ্ট বৈষম্য এবং অন্যদেরকে অনৈতিক সুযোগ প্রদান।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও তার প্রভাব
হিট প্রকল্পের পরিচালকগণ সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী নওফেল নিযুক্ত ছিলেন। রাজনৈতিক বিবেচনায়আসল প্রকল্প পরিচালককে বাদ দিয়ে প্রফেসর ড. আসাদুজ্জামানকে গায়ের জোরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। জুলাই ২৪ বিপ্লব হয়ে গেলেও তিনি বহাল তবিয়তে অনৈতিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া প্রফেসর ড. মোজাহার আলী (এএফটি ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট, হিট প্রজেক্ট, ইউজিসি), যিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে ২০০৯ সালে বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী সমর্থিত গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম থেকে নির্বাচন করেছিলেন। তাঁদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নিয়োগকৃত বিভিন্ন রিভিউয়ার কর্তৃক যে সকল প্রকল্প রিভিউ করা হয়েছে সেগুলোই চূড়ান্তভাবে বাছাই করা হয়েছে।
এতে প্রতীয়মান যে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিম্নমানের প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় চূড়ান্তভাবে হিট ফান্ডের জন্য মনোনীত হয়েছে। ফলে জুলাই ২০২৪ বিপ্লবের সাথে সম্পৃক্ত অনেক শিক্ষক/গবেষকদের প্রকল্প সুকৌশলে বাদ দেওয়া হয়েছে। আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, প্রকল্প প্রাপ্তির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা একটি বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামীলিগের ফ্যাসিস্ট শিক্ষকরা বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করে রিভিউয়ার হওয়া এবং প্রকল্প পাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়েছে।
এটি জুলাই বিপ্লবের পর শিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হতাশা—যা কল্পনা করা যায় না। এটি ফ্যাসিস্ট প্রভাবিত পক্ষপাতিত্বের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যা উচ্চশিক্ষার মতো একটি স্বাধীন ও বিজ্ঞানভিত্তিক খাতকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। সর্বোপরি, বর্তমান প্রশাসনকে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির দায়ে অভিযুক্ত ও বিতর্কিত করেছে।
যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও কলেজগুলোতে ফ্যাসিবাদের দোসরদের অত্যাচারের ও নির্মমতার জন্য শাস্তির দাবি রয়েছে, সেখানে আমরা তাদেরকে হিট প্রকল্প দিয়ে পুরস্কৃত করছি। একই ক্যাটাগরিতে, একই উইন্ডো ও একই ডিপার্টমেন্টে যেখানে একজন ফ্যাসিবাদী ও একজন জুলাই বিপ্লবী রয়েছে সেখানে 'জুলাই বিপ্লবী'কে বিভিন্ন টেকনিক অবলম্বন করে বঞ্চিত করা হয়েছে, অন্যদিকে ফ্যাসিবাদীদেরকে গ্রহণ করা হয়েছে। এর চেয়ে পরিহাসের ও পরিতাপের আর কি হতে পারে।
হিট রিভিউ পদ্ধতির মাধ্যমে এবং ব্যবস্থাপনার নামে অর্থের অপচয়
কিছু ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আওয়ামী-বাম ঘরনার শিক্ষকদের কিছু টাকা উপার্জন করিয়ে দেওয়ার জন্য ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে অনেক ক্ষেত্রে শুধু একটা ফোন কল করে ঢাকায় ডেকে নিয়ে প্রজেক্টগুলো রিভিউ করানো হয়েছে। এমন একজনের নাম জানা গেছে যাকে ২০টা প্রকল্প রিভিউ করতে দেওয়া হয়েছিল। আবার অনেককে তাদের পরিচিত জনের প্রকল্প রিভিউ করতে দেওয়া হয়েছিল। রিভিউয়ারদের গবেষণা প্রোফাইল নয় বরং রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাই এখানে মুখ্য ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক ও আওয়ামী সমর্থিত শিক্ষকদের রিভিউয়ের এবং প্রকল্প পাওয়ার সফলতা ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়ার কিছু উদাহরণ
রিভিউয়ারগণ: ঢাবির প্রফেসর ড. গীতি আরা নাসরিন. জাবির প্রফেসর ড. মির্জা তাসলিমা সুলতানা, জাবির প্রফেসর ড. আইনুন নাহার—এরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত বলে জানা গেছে। কিন্তু তাদের গবেষণা প্রোফাইল খুবই নিম্নমানের, এমনকি উনারা অনেক ক্ষেত্রে সাবজেক্ট বিশেষজ্ঞ ছিলেন না।
শাবিপ্রবির প্রফেসর মুহিবুল আলম, আওয়ামী প্যানেলের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। দুবারের শিক্ষক সমিতির সেক্রেটারি। তার বিভাগ থেকে তিনি এবং তারই বিভাগ থেকে একই মতাদর্শের আর একজন রিভিউয়ার মনোনীত ছিলেন। যোগ্যতা বলতে—আওয়ামী লীগ করা। লিডার! কোন গবেষণা নেই।
প্রকল্প পেতে যাচ্ছেন: অধাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল এবং সহযোগী অধাপক ড. শফিকুল ইসলাম—জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়থেকে প্রকল্প পাওয়ার জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছেন। মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম (সাবেক সেক্রেটারি, শিক্ষক সমিতি) এবং শফিকুল ইসলাম (বর্তমান সেক্রেটারি, শিক্ষক সমিতি)—দুজনেই আওয়ামীপন্থী, তাদের রাজনৈতিক প্রোফাইল অনেক উচ্চমানের, কিন্তু গবেষণা প্রোফাইল অনেক নিম্নমানের!
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বিজন মোহন চাকি প্রকল্প পেয়েছেন, যিনি আওয়ামী প্যানেল থেকে শিক্ষক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত। গবেষণা প্রোফাইল অনেক নিম্নমানের, কিন্তু রাজনীতিতে অনেক অবদান! রসায়ন বিভাগের অধ্যাপকগণ যেখানে ১০০০০+ সাইটেশন নিয়ে প্রজেক্ট পাননি সেখানে তিনি ১৪১ সাইটেশন নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাবে প্রজেক্ট পেয়েছেন।
এগুলো কেবল কিছু উদাহরণ মাত্র! আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে ৮০%-এরও বেশি প্রকল্প পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ নিষিদ্ধ আওয়ামীপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত! হিট প্রকল্পের শুরুতেই রাজনৈতিক প্রভাবে নকল প্রকল্প পরিচালক ড. আসাদুজ্জামান এবং আওয়ামীপন্থী হিট বিশেষজ্ঞ ড. মোজাহার আলীকে দায়িত্ব দিয়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। অতঃপর অনৈতিক, অস্বছ এবং রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত রিভিউ পদ্ধতি এবং মনোনয়নের কারণে আজ পুরো প্রকল্পটি হুমকির মুখে!
‘‘আমরা মনে করি, উচ্চশিক্ষার উন্নয়নের নামে এমন অস্বচ্ছ ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রক্রিয়া ও অব্যবস্থাপনা যদি চলতে থাকে, তাহলে প্রকৃত গবেষক ও শিক্ষকরা নিরুৎসাহিত হবেন এবং গবেষণার মান ও গতি ব্যাহত হবে। পাশাপাশি দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা এবং বিশ্বব্যাংক থেকে প্রাপ্ত ঋণের টাকা অপচয়হবে। একইভাবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার মান উন্নয়নের যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থতায়পরিনত হবে — যা হবে জুলাই ২৪ বিপ্লবের পরবর্তী বাংলাদেশের জন্যে এক বড় বিপর্যয়।’’