প্রেসার গ্রুপ কি চাঁদাবাজ গ্রুপে রূপান্তর হয়েছে? 

ড. নাদিম মাহমুদ
ড. নাদিম মাহমুদ © টিডিসি সম্পাদিত

প্রেসার গ্রুপ কীভাবে 'চাঁদাবাজ' গ্রুপে রূপান্তর হয়েছে তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আব্দুর রাজ্জাক বিন সোলাইমান রিয়াদ কেস স্টাডিটা ভালো করে রপ্ত করলে বোঝা যাবে। এই কৌশলকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে ‘টাকা বানানোর মেশিন’ বানিয়ে ফেলেছে তার নমুনা হলে ‘ট্রেড জোন’ নামের এক কোম্পানি কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের কয়েক কোটি টাকার খবর গণমাধ্যমে এরই মধ্যে এসেছে। জুতার মালা পরিয়ে দেয়ার ভয়, মব করানোর ভয় থেকে রক্ষা পেতে ঠিক কতজন ভুক্তভোগী/ব্যবসায়ী/রাজনীতিবিদরা এসব অর্থ দিয়েছেন, তা অবশ্যেই তদন্ত সাপেক্ষ। তবে যারা এখনো পড়াশুনা শেষই করতে পারেননি, সেই ছেলেগুলো এখন কোটি কোটি টাকার মালিক ভাবতেই অবাক লাগছে অনেকের। এখন এই নেতাদের নেতাকে যখন সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে, ‘তোমার চড়ার গাড়ি কে দিয়েছে, তখন তারা বলে আমাদের শুভাকাঙ্খী দিয়েছে।’ কিন্তু এই শুভাকাঙ্খী কেন দিয়েছেন? কিসের সুবিধায় দিয়েছেন সেই প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে আর থাকে না। ফলে নেতাদের ছত্রছায়ায় তাদের অনুসারীরা শিক্ষা নেন। আমার নেতা ওমুক গাড়িতে উঠেন, আমি উঠলে সমস্যা কি? দেন আমাকে টাকা ,না হয় চলেন জেলে। এইভাবে মাসের পর মাস মব হয়েছে দেশে, পুলিশের সামনে হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে।

সরকার ‘মব’ সন্ত্রাস নিয়ে নীরব থাকায় কিংবা মবকে স্বাভাবিক ‘প্রতিক্রিয়া’র অনুসঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করায় এই ছেলেগুলো গত কয়েক মাস মাঠে দাপিয়ে বেরিয়েছে, এ নিয়ে গণমাধ্যমগুলো নীরবতা পালন করেছে। এই সুযোগে তারা কিছু মানুষকে মারধর করেছেন, পুলিশে সোর্পদ করেছেন অনেককে। এমন একটি পরিস্থতিতে নিজেদের 'সম্মান হারানো' কিংবা অতীত অপকর্মের শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে এই 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' কবে থেকে ‘চাঁদাবাজ’ গ্রুপে পরিণত হয়েছে? বেশ কয়েক মাস আগে এক নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে মেলার আয়োজন করা এক ব্যবসায়ী নারীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল ‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক, যা সেই সময় গণমাধ্যমে বেশ চাউর হয়েছিল। কিন্তু দিন শেষে আমরা কি দেখলাম, চাঁদাবাজি চলছেই। সারাদেশে চাঁদাবাজিতে 'মত্ত' হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরও ছাত্রদের এই সংগঠনটি কার্যত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এসেছে। সরকারের নীরব ভূমিকায় রিয়াদরা হয়ে উঠেছিল 'চাঁদাবাজ'।

পুরাতন রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থের যোগান নিয়ে যুগের পর যুগই আলোচনা ছিল। ফলে দেশে ক্ষয়ে যাওয়া রাজনীতির পরিবর্তন আনতে এই ছেলেগুলো নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন কিন্তু অর্থের যোগান নিয়ে সেই পুরাতন পথে থেকেছেন। যদিও তারা বলছেন ক্রাউড ফান্ডিং করছেন। ধরলাম সেটা দিয়ে দলগুলোর খরচ চলছে, তাহলে তাদের ব্যক্তিগত খরচ, পরিবার কিংবা যাদের সন্তান আছে সেই খরচগুলো কীভাবে আসছে? এদের মধ্যে ঠিক কতজন দল থেকে বেতন পাচ্ছেন? বেতন যদি না পান, তাহলে তারা তো ফুলটাইম রাজনীতি করে চাকরি করছেন না, ওদের চলে কী করে? এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আপনি কেন অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই প্রশ্ন করেন না? তাদের নেতা-কর্মীরা কীভাবে চলে, সেই প্রশ্ন করেন না?
 
তাদের কাছে প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই। কারণ, আপনাদের কাছ থেকে মানুষ ও্‌ই পরিবর্তনগুলো দেখতে চেয়েছিল, ওই স্বচ্ছতাটুকু দেখতে চেয়েছে। কিন্তু আপনারা সেটা দেখাতে ব্য‍‍র্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

কাঁচা বয়সে রিয়াদের মত ছেলেরা 'চাঁদাবাজীতে' জড়িয়ে পড়লে, সেই দেশে দুঃখের কোন সীমা থাকে না। অথচ তারাই জুলাইয়ে এই রাস্তাগুলোতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে, স্কুল-কলেজ ফেলে দেশের প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, অথচ কয়েক মাসের ব্যবধানে ওদের নেতৃত্বে নোংরামি ঢুকে পড়েছে, লোভের বিষে পুরো শরীরটা নীল হয়ে গিয়েছে। অথচ এদের অধিকাংশরাই সমাজের অসচ্ছল/নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছে। এখন এই ছেলেগুলো ক্ষমতার দাপটে যখন ‘ধরাকে সরা মনে করে’ তখন কার্যত সেই সমাজ-ব্যবস্থা একবারে ভেঙ্গে পড়ে। একটা রিজম দুর্নীতি, অনিয়ম, নানা অপরাধ মাথায় নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। আর একটি রিজম ‘পরিবর্তন/সংস্কারের' কথা বলতে এসে নিজেদের মানসিকতার যে বারটা বাজিয়ে দিয়েছে, দেশটাকে অশান্তির শীর্ষে নিয়ে যাচ্ছে তা কেউ টের পাচ্ছে না।

হয়ত সবাই নয়, তবে দেশের গণমাধ্যমগুলো যদি এসব রাজনৈতিক নেতাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেন, এক বছর আগের পরিবারের আর্থিক/পারিপাশ্বিক অবস্থা আর বর্তমান অবস্থান তফাৎ নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করে, তাহলে দেখা যাবে এদের একটি বড় অংশই ‘নৈতিকতা’ হারিয়ে অনৈতিক পন্থায় অর্থ উপার্জন করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। অনেকেই টিনের ঘর ভেঙে পাকা ঘর উঠেছে। এমন সুবিধাবাদীদের কাছ থেকে কতটুকু পরিবর্তন আসা করা যায়?

ড. নাদিম মাহমুদ: লেখক ও গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com

(মতামত লেখকের নিজস্ব)