বাঘের সঙ্গে লড়াই সুন্দরবনে ২৫ বছরে প্রাণ গেল ৪২৫ জনের
- ২৯ জুলাই ২০২৫, ২১:১৪
সুন্দরবন মানেই বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন আর রয়েল বেঙ্গল টাইগারের রাজত্ব। কিন্তু সেই সহাবস্থানের গল্প আজ ভয়াবহ এক দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে। বনবিভাগের তথ্য বলছে, গত ২৫ বছরে (২০০১-২০২৫) সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মারা গেছেন অন্তত ৪২৫ জন। আহত হয়েছেন আরও ৯৫ জন। তবে স্থানীয়দের দাবি, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। অনেক হতাহত বন বিভাগের তালিকায় আসেই না।
২০০০ সালের দিকে শরণখোলা উপজেলার আব্দুস সামাদ হাওলাদার সুন্দরবনের গহীনে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণের শিকার হন। গলার নিচে কামড়ে ধরে তাকে ছিন্নভিন্ন করে বাঘটি। প্রাণে বেঁচে ফিরলেও হারান দুই চোখ। এমন শত শত হৃদয়বিদারক ঘটনার একটি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হলেন জেলে শিপার হাওলাদার। ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর সকালে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। চারদিন পর তার বিচ্ছিন্ন মাথা ও প্যান্ট উদ্ধার করে স্থানীয়রা। অনুমতি না থাকায় শিপারের পরিবার কোনো সরকারি সহযোগিতা পায়নি। এখন শিপারের বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী মোরশেদা বেগম ও পাঁচ বছরের মেয়ে সিনথিয়া অভাবে দিন কাটাচ্ছেন।
বাঘের আক্রমণের শিকার হওয়া পরিবারগুলোর জন্য সরকারি সহায়তা থাকলেও তা অত্যন্ত সীমিত। ২০১১ সালে একটি ক্ষতিপূরণ নীতিমালা চালু হয়। এই নীতিমালা অনুযায়ী বাঘের আক্রমণে মারা গেলে পরিবার পায় এক লাখ টাকা, আহত হলে ৫০ হাজার, আর বাড়িঘরের ক্ষতি হলে ২৫ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ প্রায় ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। তবে বনসংলগ্ন মানুষের দাবি, এই সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তারা চান মাসিক ভাতা ও পুনর্বাসনের টেকসই ব্যবস্থা।
তবে বাঘ শুধু আক্রমণ করে না, বাঘ বাড়ছেও এমনটিই বলছে বন বিভাগ। ২০১৮ সালে একটি জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। এরপর ২০২৩ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপ পদ্ধতিতে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট রেঞ্জে করা জরিপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ১২৫। অর্থাৎ ৫ বছরে বাঘ বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ জানান, বাঘ রক্ষায় ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন, ৬০ কিলোমিটার ফেন্সিং সম্পন্ন, সুপেয় পানি ও আবাসস্থল তৈরিসহ নানা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, বাঘ বিধবাদের জন্য তিনটি নির্দিষ্ট খাল নির্ধারণ করা হয়েছে যেখানে তারা মাছ ধরতে পারেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘ বাড়ার এই হার আশানুরূপ নয়। সুন্দরবন রক্ষায় আমরা সংগঠনের সমন্বয়কারী নূর আলম শেখ বলেন, ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক বাঘ সম্মেলনে বলা হয়েছিল ১২ বছরে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে। সেই লক্ষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ খুবই পিছিয়ে। তিনি অভিযোগ করেন, সুন্দরবনের আবাসস্থল এখনও নিরাপদ নয়। জলবায়ু পরিবর্তন, বিষ দিয়ে মাছ শিকার, চোরাচালান সিন্ডিকেট সব মিলিয়ে বাঘ এবং সুন্দরবন উভয়ই চরম হুমকিতে।
বিশেষজ্ঞদের মত, বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের নিরাপদ বাসস্থান, খাদ্যের পর্যাপ্ততা, প্রজননক্ষম পরিবেশ এবং চোরা শিকার দমন সবই জরুরি। আর সেইসঙ্গে দরকার বননির্ভর মানুষের জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা। কারণ সুন্দরবনের প্রকৃত রক্ষা শুধু বাঘ নয়, মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের সঠিক ভারসাম্যে।