এনসিপির নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত: ডোনেশন নাকি চাঁদাবাজি?

মো. ফিরোজ আলম
মো. ফিরোজ আলম © টিডিসি সম্পাদিত

ল্যাটিন শব্দ donatio যার অর্থ উপহার বা দান। এটি এসেছে লাতিন ক্রিয়া donare থেকে, যার মানে to give বা দান করা। মধ্যযুগে পুরানো ফরাসি ভাষায় donacion থেকে ইংরেজিতে আসে donation হিসেবে যার অর্থ স্বেচ্ছায় দেওয়া অর্থ বা সম্পদ। বাংলা ভাষায় ডোনেশন অর্থ অনুদান, সহায়তা, উপহার ইত্যাদি। ডোনেশন বা অনুদান হল ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক স্বেচ্ছায় অর্থ, সম্পদ বা সম্পদ-সামগ্রী প্রদান, যা সাধারণত কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা উদ্দেশ্যকে সহায়তা করার জন্য দেওয়া হয়। প্রাচীন যুগে সাধারণ মানুষ পুণ্য অর্জনের জন্য বা ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে মন্দির, পুরোহিত বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুদান দিত। তখনো সমাজে রাজকীয় দান বা দানধর্ম গৌরবের প্রতীক হওয়ায় ধর্নাঢ্য ব্যক্তি কিংবা রাজা-বাদশারাও গরিবদের খাওয়াতেন, মন্দির গড়তেন, পুকুর খনন করতেন। মধ্যযুগে ইউরোপে চার্চ ও খ্রিষ্টান মঠগুলো অনুদান গ্রহণ করত, যা “Tithe” নামে পরিচিত (ফসল বা আয়-এর ১০%)। ইসলাম ধর্মে জাকাত ও সদকা একটি বাধ্যতামূলক সামাজিক অনুদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

আধুনিক যুগে ১৮-১৯শ শতাব্দী ইউরোপ ও আমেরিকায় রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং দলীয় কার্যক্রম ও প্রচারণার জন্য অর্থের প্রয়োজন হলে ধনী শ্রেণি ও ব্যবসায়ীরা দলকে অনুদান দিতে শুরু করে। রাজনৈতিক দলকে, দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক বা পৃষ্ঠপোষক যারা দলের আদর্শে বিশ্বাস করেন, বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, শিল্প প্রতিষ্ঠান, প্রবাসী, পেশাজীবী সাধারণত ডোনেশন দিয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত বা স্বার্থনির্ভর উৎস থেকেও ডোনেশন করে থাকে যা স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সাধারণত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখতে, ভবিষ্যতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন-সরকারি টেন্ডার, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর ছাড় ইত্যাদি পেতে ডোনেশন করে থাকে। রাজনৈতিক দলের সাথে সুসম্পর্ক রেখে ভবিষ্যতে অযাচিত হয়রানি থেকে বাঁচতেও রাজনৈতিক দলগুলোকে ডোনেশন দিয়ে থাকে।

উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোকে ডোনেশনর উৎস প্রকাশ করতে হয় ফলে দাতারাও সঠিক তথ্য জেনে, বুঝে ডোনেশন করেন। কখন কার কাছে থেকে কতো ডোনেশন এসেছে, এই টাকা কোথায় কী কাজে ব্যয় করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। অনেক সময় একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ডোনেশনের সীমা নির্ধারণ করা থাকে।

চাঁদাবাজি: কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জোরপূর্বক, ভয় দেখিয়ে বা বলপ্রয়োগ করে, হুমকি দিয়ে, শারীরিক আক্রমণ, প্রশাসনিক হয়রানি কিংবা প্রভাব খাটিয়ে কারো কাছ থেকে টাকা বা সম্পদ আদায় করাকে চাঁদাবাজি বলে। চাঁদাবাজির অনেক ধরণ রয়েছে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - 

১.ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে, কারো মাধ্যমে বা লিখিতভাবে হুমকি দিয়ে অর্থ বা সম্পদ আদায় করা।
২. আগ্নেয়াস্ত্রের বা দেশীয় অস্ত্র বা মারধরের ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়।
৩. দোকান, ব্যবসা, নির্মাণকাজ, বা পরিবহণ খাত থেকে অবৈধভাবে নিয়মিত চাঁদা আদায়।
৪. দলীয় পরিচয়ে বা নেতা-সমর্থকদের মাধ্যমে ক্ষতিসাধনের হুমকি দিয়ে অন্যায়ভাবে অর্থ আদায় করা।
৫. চাকরি কিংবা কর্মক্ষেত্রে কাউকে বিধিবহির্ভূত সুবিধা দিয়ে কিংবা ভবিষ্যতে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে অর্থ আদায়।
৬. সমাজসেবার নামে বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় চাঁদা আদায় করা।
৭. প্রশাসনিক হয়রানি কিংবা গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে অর্থ বা সম্পদ আদায় করাও চাঁদাবাজি।

এনসিপির ডোনেশন নাকি চাঁদাবাজি?
ফ্যাসিবাদ পলায়নের পর বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী উপদেষ্টা হন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা। উপদেষ্টা এবং অন্যান্য সমন্বয়কদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি -(এনসিপি)। ছাত্রদের মধ্যে থেকে উপদেষ্টা এবং সমন্বয়কদের অধিকাংশই নিম্নমধ্যবিত্ত এবং সাধারণ পরিবারের সন্তান। যারা অধিকাংশই পড়াশোনার খরচ যোগাতেন টিউশনি করে, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে কিংবা পার্টটাইম চাকরি করে। কিন্তু তাদের নেতৃত্বে সরকার গঠনের ১ বছরের মধ্যেই আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো করেই এরা অধিকাংশই হয়ে গেলেন কোটিপতি, অনেকেই শতকোটি কিংবা কয়েকশো কোটি টাকার মালিক। বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ির মালিক, বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার।

এনসিপি এবং নেতাকর্মীদের এই সম্পদের উৎস জানতে চাইলে তাঁরা সগর্বে প্রচার করেন, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা জন্য ডোনেশনের বয়ান। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বয়ান দিয়ে ডোনেশন নাকি চাঁদাবাজি করে প্রচার করতেছেন ডোনেশন হিসেবে তা দেখে যাক অসংখ্য অভিযোগের মধ্যে কয়েকটি

আলোচিত ঘটনার বাস্তবতার আলোকে-
১. এনসিপি নেতা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাত্র প্রতিনিধি রিয়াদসহ দুই জন আওয়ামীলীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক এবং পলাতক এমপি শাম্মী আহমেদ এর বাসা থেকে ৫০ লাখ টাকা ডোনেশন আনতে গিয়ে হাতেনাতে ১০ লাখ টাকা আটক হন। শাম্মী আহমদের পিতা মহিউদ্দিন আহমেদ ওরফে পান্না মিয়া বরিশাল জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন এবং ১৯৭৩, ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালে তিনবারের আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন। শাম্মী ছিলেন প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, আওয়ামী লীগের এমপি। একই সাথে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি নিজের দল আওয়ামী লীগ থাকতে অন্য নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিকে এতো টাকা ডোনেশন দেয়ার প্রশ্নই আসে না। নিশ্চয়ই শাম্মী আহমেদ এর সম্পদ দখল কিংবা গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে, দলীয় পরিচয়ে অর্থ আদায় করা হয়েছে যা ডোনেশন নয় বরং চাঁদাবাজি।

২. দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির পরিত্যক্ত লোহার স্ক্র্যাপ দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয় করেন সেনাকল্যাণ সংস্থা। স্ক্র্যাপ ভর্তি দুটি ট্রাক খনি থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলে ডোনেশনের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। আপস-মীমাংসা না হওয়ায় সমন্বয়ক পরিচয়ে কয়েকজন ট্রাকে উঠে চালককে জিম্মি করে অর্থ দাবি করেন। খবর পেয়ে যৌথ বাহিনী ও র‍্যাব গিয়ে পার্বতীপুর উপজেলা এনসিপির মুখ্য সংগঠক তারিকুল ইসলামকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হলেও অন্যেরা পালিয়ে যান। এই জাতীয় কর্মকাণ্ড হলো ব্যবসা, নির্মাণকাজ, বা পরিবহণ খাত থেকে অবৈধভাবে ডোনেশনর নামে চাঁদাবাজি।

৩. পিরোজপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও এনসিপির প্রতিনিধি মুসাব্বির মাহমুদ সানি ও তাঁর সহযোগী মিলন শিকদারসহ কয়েকজন পিরোজপুর সেতুর টোলঘরে ও নির্মাণাধীন মডেল মসজিদ প্রকল্প এলাকায় গিয়ে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন। মীমাংসা না হওয়ায় তারা টোলঘর আগুন দেন এবং মসজিদ প্রকল্পের ঠিকাদারের অফিসে ভাঙচুর এবং মারধর করে ৫ লাখ টাকা লুটপাট করেন। পরবর্তীতে গ্রেফতার করা হলে সত্যতা মেলে, যা আপাতদৃষ্টিতে সমাজসেবার নামে বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগই যুক্ত করা যায়।

৪. জেলা প্রশাসক নিয়োগে 'অবৈধ হস্তক্ষেপ’ এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই ছাপার কাগজে ‘কমিশন বাণিজ্য, অনিয়ম ও ৪০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে এনসিপি’র যুগ্ম সদস্য সচিব পদে থেকে গাজী সালাহউদ্দিন তানভীরকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এগুলো হলো, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে পোস্টিং, প্রমোশন এবং তদবিরের নামে ডোনেশন নয় বরং চাঁদাবাজি।

৫. এনসিপি নেতা ইমামুর রশিদ একজন নারী উদ্যোক্তার থেকে ৭ লাখ টাকা নেয়ার ভিডিও ভাইরাল। পরবর্তীতে জানা যায় তার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে এনসিপির নেতৃবৃন্দ ৪৮ লাখ টাকা নিয়েছেন সরকারি কাজের টেন্ডার পাইয়ে দিবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে। যদিও এনসিপি নেতাদের দাবি ওই নারী এনসিপিতে টাকা অনুদান দিয়েছেন, তার কাছ থেকে কোনো চাঁদাবাজি করা হয়নি। একজন নারী উদ্যোক্তা এতো টাকা ডোনেশন দেয়ার প্রশ্নই আসে না যা চাঁদাবাজির অন্তর্ভুক্ত। সারাদেশে ডোনেশনের নামে এভাবে অসংখ্য চাঁদাবাজি করায় বাধ্য হয়ে একযোগে এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটি ব্যতীত সমগ্র কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। এরকম অসংখ্য ঘটনায় প্রমাণিত হয় এনসিপি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার কথা বলে ডোনেশনের নামে চাঁদাবাজি করেছে।

লেখক: সাবেক গণসংযোগ সম্পাদক, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ ও এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়