সীমান্তে আর কত মৃত্যু হলে আমরা জেগে উঠব?

সীমান্ত
সীমান্ত © প্রতীকী

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রতিনিয়ত প্রাণহানি আর অশান্তির ঘটনা যেন থেমে নেই। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হচ্ছে দেশের তরুণরা, আহত হচ্ছেন নিরীহ মানুষ, আর মানবতাবিরোধী কাজ চলছে চোখের সামনে। গত সপ্তাহে ফেনী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও শেরপুর সীমান্তে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনাগুলো এই করুণ বাস্তবতার শিলালিপি মাত্র।

একদিকে সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রবেশের অভিযোগ উঠলেও, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে—যেখানে গুলি চালানো, নিরীহ মানুষদের ঠেলে দেয়া এবং তথ্য গোপনের মধ্য দিয়ে সীমান্ত এলাকা যেন মৃত্যুর নীরব মঞ্চে পরিণত হচ্ছে।

বাংলাদেশের জনগণ চায় শান্তি, চায় মর্যাদা। কিন্তু যখনই কোনো প্রাণহানি ঘটছে, তখন প্রতিবাদ আসছে বাক্যবাণের সীমাবদ্ধতায়। প্রশ্ন হচ্ছে, ‌‘সীমান্তে আর কত মৃত্যু হতে হবে, আমরা কখন জেগে উঠব? কখনো কি আমরা সীমান্তে নিরাপত্তা, শান্তি ও মানুষের সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে পারব?’

এই প্রশ্নগুলোই এখন সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের ভাবতে হবে, কেবল প্রতিবাদ নয়, কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে সীমান্তে স্থায়ী শান্তি ও আস্থার পরিবেশ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়।

ফেনী সীমান্তে গুলি চালানো কাদের বিরুদ্ধে এই মৃত্যুপরোয়ানা?

গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাত ১২টার পর ফেনীর পরশুরাম উপজেলার বাঁশপদুয়া সীমান্তে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিলোনিয়া অংশে প্রবেশ করেন তিন বাংলাদেশি যুবক—মিল্লাত হোসেন (২১), মো. লিটন (৩২) এবং মো. আফছার (৩১)। তারা ২১৬৪/৩এস নম্বর পিলার অতিক্রম করে ভারতের ভেতরে গেলে বিএসএফ গুলি ছোড়ে। মিল্লাত ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হন এবং পরে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে মারা যান। লিটনকে নিয়ে যাওয়া হয় বিলোনিয়া হাসপাতালে, সেখানেই তার মৃত্যু হয়। আফছার গুরুতর আহত অবস্থায় দেশে ফিরে আসেন।

এই এলাকা “চোরাকারবারি প্রবণ” হিসেবে পরিচিত বলেই কি গুলি চালিয়ে প্রাণ নেওয়া বৈধ হয়ে যায়? সন্দেহভাজন হলেও কি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংহিতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষার অর্থ কি গুলি চালিয়ে মানুষ মারার লাইসেন্স দেওয়া?

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে গুলিবিদ্ধ দুই তরুণ: সত্য চাপা পড়ছে, না চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে?

একই দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) ভোরে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার সিংনগর সীমান্তের ১৬৪/৫-এর ১এস পিলার এলাকা দিয়ে গরু আনতে ভারতে প্রবেশ করেন সুমন (২৮) ও সেলিম (২৫) নামের দুই যুবক। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভারতের দৌলতপুর ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা গুলি চালালে তারা আহত হন এবং গোপনে দেশে ফিরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে বিজিবি বলছে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের স্বজন ও বিএসএফ—দু’পক্ষই অস্বীকার করেছে।

যদি গুলি না চলে থাকে, তবে আহত দুই যুবক কোথায়? তারা কেন গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছেন? আবার যদি গুলি চলে থাকে, তবে কেন সত্য লুকোনো হচ্ছে?

এই ধরনের তথ্য বিভ্রান্তি, দ্বৈত ভাষ্য এবং তথ্য-গোপনতা সীমান্ত পরিস্থিতিকে আরও ধোঁয়াটে করে তোলে। এতে রাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং জবাবদিহিতা দুটোই প্রশ্নের মুখে পড়ে।

শেরপুর সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা পুশইন: মানবিকতা, না একতরফা দায় চাপানো?

গত বুধবার (২৩ জুলাই) রাতে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও সীমান্ত দিয়ে ভারতের বিএসএফ ঠেলে পাঠায় ২১ জন রোহিঙ্গাকে, যাদের মধ্যে রয়েছে ১১ জন শিশু। বিজিবি সূত্র জানায়, তারা সবাই কক্সবাজারের বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ২০১৭ সালে ভারতে অনুপ্রবেশ করেন এবং সেখানকার পুলিশ এক মাস আগে তাদের গ্রেপ্তার করে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে। বর্তমানে আটক রোহিঙ্গাদের স্থানীয় বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে এবং যাচাই-বাছাই চলছে।

এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়। তাদের ঠেলে ফেরত পাঠানো একতরফা ও আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভারত যেভাবে তাদের ফেরত পাঠিয়েছে, তা শুধু অমানবিক নয়, বরং বাংলাদেশের কাঁধে অপ্রাপ্য একটি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। প্রতিবেশী হিসেবে এমন পদক্ষেপ নৈতিক, কূটনৈতিক এবং মানবিক—তিনটি দিক থেকেই দায়িত্বজ্ঞানহীন।

প্রতিবাদ জানানোই কি যথেষ্ট? শক্তিশালী কূটনৈতিক চাপে কি সময় আসেনি?

প্রতিটি ঘটনার পর বিজিবি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ‘প্রতিবাদ জানানো হয়েছে’—এই বিবৃতি আমরা শুনি। কিন্তু এই প্রতিবাদ কি সীমান্ত হত্যা রোধ করছে? প্রতিবাদের ভাষা যদি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কর্ণকুহরে প্রবেশ না করে, তবে কূটনীতিকে নতুন ভাষা ও নতুন কৌশল খুঁজতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক সক্রিয়তা, দ্বিপক্ষীয় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, এবং সীমান্ত চুক্তির কার্যকর বাস্তবায়ন এখন অনিবার্য।

সীমান্তে শান্তির বদলে শোক, আস্থার বদলে আতঙ্ক কেন?

সীমান্ত একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা-বেষ্টনী। কিন্তু তা যদি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়, তবে আস্থা থাকে না; থাকে আতঙ্ক। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, কিন্তু সেই সম্পর্ক তখনই টেকসই হবে, যদি সীমান্তে রক্ত নয়; ভরসা প্রবাহিত হয়। উভয় রাষ্ট্রের উচিত সীমান্ত ইস্যুকে রাজনৈতিক ফাইল নয়; মানবিক অগ্রাধিকারে পরিণত করা। যুদ্ধ নয়, শত্রুতা নয়—প্রয়োজন যৌথ কৌশল, টেকসই সহযোগিতা এবং মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি।

সীমান্ত শুধু লাইন নয়, মানবিক চুক্তির প্রতীক:

সীমান্তে যে গুলি চলে, তা কেবল একজন মানুষের বুক চিরে যায় না, তা বিদ্ধ করে দুই রাষ্ট্রের আস্থার ছায়া, বিশ্বাসের বন্ধন, আর বহুকষ্টে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের ভিত। বাংলাদেশ একটি শান্তিপ্রিয় দেশ, কিন্তু সেই শান্তি কোনোদিনই আত্মমর্যাদা বিসর্জনের নাম হতে পারে না। প্রতিটি বাংলাদেশির জীবন অমূল্য। সেই জীবনের সুরক্ষা শুধু আত্মীয়স্বজনের দায়িত্ব নয়, এটি রাষ্ট্রের পবিত্র দায়।

এখন সময় এসেছে চোখে চোখ রেখে সত্য বলার। কথা নয়, কাজের মাধ্যমে বন্ধুত্বের প্রমাণ দিন। আর একটি গুলিও যেন সীমান্তে না চলে, আর একটি লাশ যেন ফেরে না কাঁটাতারের এ পাশে। এই প্রতিশ্রুতি শুধু কূটনৈতিক বিবৃতিতে নয়, রাষ্ট্রনায়কদের চুক্তি ও পদক্ষেপের মাধ্যমে এখনই বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ সীমান্ত মানে কেবল মানচিত্রের রেখা নয়— সীমান্ত মানে জীবনের অধিকার, মর্যাদার শপথ, আর মানবিকতার শেষ আশ্রয়।

লেখক: রাশেদুল ইসলাম রাশেদ

সাংবাদিক ও শিক্ষক