গাজায় দুই-তিন দিনও চলে যাচ্ছে খাবার ছাড়া
- ২৬ জুলাই ২০২৫, ২০:১৬
বিবিসি গাজার সংবাদ সংগ্রহের জন্য নির্ভর করে এমন তিনজন বিশ্বস্ত ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক জানিয়েছেন, খাবারের জন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কীভাবে তাদের লড়াই করতে হচ্ছে এবং এক বা দুই দিন না খেয়েও পার করতে হচ্ছে।
এখন এই সাংবাদিকদের পরিস্থিতি আর ১০টা গাজাবাসীর মতোই।
তাদের সবার ক্যামেরা চলছে, বিবিসির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও পাঠাচ্ছেন। এমনকি, যেদিন তাদের কাছের কোনো স্বজন মারা গেছেন সেদিনও তারা কাজ থামাননি।
তাদের নিজেদের ঘর হারিয়েছে, কিংবা ইসরায়েলি সেনা অভিযানের সময় পরিবারের সঙ্গে পালাতে হয়েছে। তারপরও কাজ ছিল চলমান।
তাদের মধ্যে একজন রিপোর্টিং চলাকালে ইসরায়েলি বোমা হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন।
কিন্তু তার কাছে জীবনের সব চাইতে সংকটময় পরিস্থিতি মনে হচ্ছে এখনকার এই সময়টা।
তিনি বলছেন, ‘আমার জন্মের পর থেকে এটাই আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন সময়। আমাদের এখন বিশাল কষ্ট আর অভাবের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে।’
বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এখনো গাজার পরিস্থিতিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেননি, কিন্তু জাতিসংঘের সংস্থাগুলো মানবসৃষ্ট গণ-অনাহারের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে।
এজন্য সংস্থাটি দায়ী করেছে ইসরায়েলকে, যারা ফিলিস্তিনে যাবতীয় সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। তবে ইসরায়েল সেই দায় অস্বীকার করেছে।
নিরাপত্তার কারণে বিবিসি তাদের এই সহকর্মীদের নাম গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তারা বলেছেন, পরিবারের ছোট ও দুর্বল সদস্যদের জন্য খাবার জোগাড় করতে না পারা সবচেয়ে কষ্টের বিষয়।
গাজা শহরে থাকা আমাদের এক ক্যামেরা পারসন, যিনি চার সন্তানের বাবা, তিনি বলছেন, ‘আমার ছেলে অটিজমে আক্রান্ত, সে বুঝতেই পারে না চারপাশে কী হচ্ছে। সে জানে না যে আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি, আর সে কথা বলতে পারে না।’
‘সাম্প্রতিক দিনে, সে এতটাই ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছে যে নিজের পেটের ওপর হাত দিয়ে মারছে, আমাদের বোঝানোর জন্য যে সে খেতে চায়।’
বিবিসির সবচেয়ে কনিষ্ঠ সহকর্মী, যিনি দক্ষিণ গাজায় থাকেন, তিনি তার মা-বাবা ও ভাইবোনদের মধ্যে একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি।
তিনি বলেন, ‘আমি সারাক্ষণ ভাবি কীভাবে পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করবো। আমার ছোট বোন, ওর বয়স ১৩ বছর, বারবার খাবার আর পানি চায়। কিন্তু আমরা কিছুই দিতে পারি না। যেটুকু পানি পাই, সেটাও দূষিত।’
বিবিসি অন্যান্য গণমাধ্যম সংস্থার সাথে এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে তারা গাজায় যেসব স্থানীয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করে, তাদের পরিস্থিতি নিয়ে ‘চরমভাবে উদ্বিগ্ন’।
‘মাসের পর মাস ধরে এই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকরাই গাজার মাটিতে বিশ্বের চোখ ও কান হয়ে কাজ করছে।’
‘তারা যাদের নিয়ে রিপোর্ট করছে, এখন তারা নিজেরাও সেই একই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি,’ বিবিসি, এএফপি, এপি ও রয়টার্সের বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে গাজায় কী ঘটছে তা বলা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
‘আমার সবসময় খুব ক্লান্ত আর একেবারে নিস্তেজ লাগে, এমনকি মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়,’ বলছিলেন গাজা শহরে আমাদের সঙ্গে কাজ করা এক অভিজ্ঞ সাংবাদিক, যিনি তার মা, বোন এবং দুই থেকে ১৬ বছর বয়সী পাঁচ সন্তানের দেখাশোনা করছেন।
তিনি বলছেন, ২১ মাসের যুদ্ধে তিনি ৩০ কেজি ওজন হারিয়েছেন।
‘আগে আমি খুব দ্রুত নিউজ রিপোর্ট শেষ করতে পারতাম। কিন্তু এখন স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ায় খুব ধীরে ধীরে কাজ করি," তিনি জানান।
‘বিভ্রান্তি আর ক্লান্তি সবসময় আঁকড়ে থাকে। এই অনুভূতি বোঝানো কঠিন,’ বলেন বিবিসির দক্ষিণ গাজার ক্যামেরা পারসন।
‘আমার পেট মোচড়ায়, মাথা ধরে থাকে, শরীর ভেঙে পড়ে, ভীষণ দুর্বল লাগে।’
‘আগে আমি সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত টানা কাজ করতাম, আর এখন একটা রিপোর্ট ঠিকমতো করতে পারি না। শুধু মাথা ঘোরে।’
সম্প্রতি শুটিং চলার সময় তিনি অচেতন হয়ে পড়েন, কিন্তু পরে আবার কাজে ফেরেন।
যুদ্ধ চলাকালে খাদ্যঘাটতি সবসময়ই একটা সমস্যা ছিল, তবে আগে যারা বাইরে থেকে বেতন পেতেন তারা খুব বেশি দামে হলেও স্থানীয় বাজার থেকে ন্যূনতম জিনিসপত্র কিনতে পারতেন। এখন সেই বাজারগুলোও প্রায় ফাঁকা।
‘আমি এখন চ্যারিটি কিচেন অর্থাৎ, দাতব্য রান্নাঘর থেকে খাবার নিতে বাধ্য হচ্ছি। সাম্প্রতিক দিনগুলোয় আমার সন্তানরা দিনে একবার খাবার পাচ্ছে, সেটাও সামান্য কিছু। যেমন ডাল, ভাত আর পাস্তা,’ বলছেন গাজা শহরের সাংবাদিক, যার চারটি ছোট শিশু আছে।
দুজন বলেন, তারা এখন পানিতে সামান্য লবণ মিশিয়ে খাচ্ছেন যাতে ক্ষুধা দাবিয়ে রাখা যায়।
একজন বলেন, তিনি মাঝে মাঝে দিনে একবার খাবার হিসেবে ৫০ গ্রাম বিস্কুট কিনতে পারেন, যার দাম পড়ে ৩০ শেকেল। (৯ মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় যা ১১০০ টাকারও বেশি)
এখন টাকা পাওয়াটাও বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সেটাও টাকার দালালদের মাধ্যমে লেনদেন করতে হয়।
‘যদি আমার নগদ টাকার দরকার হয়, বেশিরভাগ সময় সেটা পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও সেই টাকা তুলতে মোট অংকের ৪৫ শতাংশ ফি দিতে হয়,’ বলেন গাজা শহরের এক ক্যামেরা পারসন।
‘মানে আমি যদি ১০০০ ডলার তুলতে যাই, আমি পাবো মাত্র ৫৫০ ডলার। পুরো প্রক্রিয়াটাই ক্লান্তিকর, আর এখানকার দোকানদাররা কেবল নগদ টাকাই চায়।’
‘এই কষ্টের কারণ হলো ব্যাংকগুলো বন্ধ। এই অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা ক্ষুধার পর আমাদের আরেক ধরনের ভোগান্তিতে ফেলেছে,’ বলেন দক্ষিণ গাজার বিবিসির এক সহকর্মী।
আগে, ইসরায়েল কর্তৃক অনুমোদিত বিবিসির সাংবাদিকরা, যেমন আমি নিজেও, নিয়মিত গাজায় যেতে পারতাম রিপোর্ট করতে, এমনকি যুদ্ধ চলাকালেও।
কিন্তু, ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, ইসরায়েল ও মিশর বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশ বাধা দিয়ে আসছে। তখনও রাফা সীমান্ত ক্রসিং খোলা ছিল।
শুধু ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাথে সীমিত সংখ্যক সফর ছাড়া গাজার আর কোথাও রিপোর্টিং করার সুযোগ পায়নি বিদেশি সাংবাদিকরা।
বিবিসি এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যম তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা আবারও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি যেন তারা সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশ ও প্রস্থান করতে দেয়।’
এই সপ্তাহে, যুক্তরাজ্যসহ ২৮টি দেশ একযোগে একটি বিবৃতি দিয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, ‘গাজার যুদ্ধ এখনই শেষ হওয়া উচিত।’
তারা ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তার দায়িত্ব পালন করতে এবং পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাঠিয়ে এই মানুষদের তিলে তিলে মারা বন্ধ করতে বলেছে।
সুত্র: বিবিসি বাংলা