শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী

জীবন দিয়ে আপনি দেশ ও জাতিকে সম্মানিত করে গেছেন

প্রফেসর ড. মো. আকতারুজ্জামান
প্রফেসর ড. মো. আকতারুজ্জামান © টিডিসি সম্পাদিত

দেশের জাতীয় পলিসি লিখেছি, অনেক একাডেমিক আর্টিকেল লিখেছি, সংবাদপত্রে অসংখ্য কলাম লিখেছি কিন্তু এমন আবেগ ও মায়া দিয়ে জীবনে কিছু লিখিনি। শিক্ষক মানুষ, তাই একজন শিক্ষক বা একজন মানুষের প্রতি ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন না হলে গায়ে লাগে। একজন ভাল শিক্ষক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো, একটা সমাজকে পাল্টে দিতে পারে। আর শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী তো নিজের জীবন তুচ্ছ করে এই দেশ ও জাতিকে সম্মানিত করে গেছেন। এমন শিক্ষককে অবশ্যই জাতীয়ভাবে সম্মানিত করতে হবে যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মানুষ একজন মহান শিক্ষককে স্মরণ করে বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালবাসায়। ঘুণে ধরা সমাজে শিক্ষকরাও ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়, তবে এক দশক আগেও বিষয়টি এমন ছিল না - উনারা ছিলেন সততা ও আদর্শের প্রতীক। আজ উনারা বিচ্যুত হয়েছেন, জাতি বিচ্যুত হয়েছে, তাই দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী অবশেষে শিক্ষক মাহরীন চৌধুরীর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। একজন শিক্ষকই কিন্তু মন্ত্রী, সচিব, অফিসার, সমাজসেবক তৈরি করেন, তাই তাঁদের সম্মান সবার উপরে সবসময়, সবদেশে। অষ্ট্রেলিয়ায় চাকরি ও ইউনিভার্সিটি এনগেজমেন্ট নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকি, তবে দেশের ভাল সকল প্রবাসীর মতো আমিও চাই। অফিসের চা বিরতিতে অষ্ট্রেলিয়ার সংবাদে দেখলাম বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি ফাইটার প্রশিক্ষণ বিমান মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের উপর বিধ্বস্ত হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল, বাসায় ফিরে টিভিতে দেখছি আর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। গতকাল পর্যন্ত প্রায় ২৫-৩০ জন আগুনে পুড়ে মারা গেছেন, অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, এর মধ্যেও ৮-১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে হাসপাতাল সূত্রে। আমরা যেন গুজব সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকি, ভুক্তভোগীদের অযাচিত ছবি ও ভিডিও নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া থেকে বিরত থাকি। এমন প্রতিটি মৃত্যুই হৃদয়বিদারক, আমাদের ব্যাচের এক বন্ধুর মেয়ে নাজিয়ার মৃত্যুর একুশ ঘণ্টা পরে ছেলে নাফিও চলে গেল। বাবা-মায়েরা কীভাবে এমন শোক সইবে জানি না।

অর্ধশতক ধরে চলে আসা গতানুগতিক ও অকেজো সিস্টেম রাতারাতি ভাল হবে না ঠিকই কিন্তু পরিবর্তনের শুরু হোক এখান থেকেই। এমন মর্মস্পর্শী প্রতিটি ঘটনার দায়ভার সবার আগে পড়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার উপর যেখানে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বাসা বেঁধেছে কয়েক যুগ ধরে। মানুষ পরিবর্তন চাই, ভাল কিছু দেখতে চাই। দুনিয়ার কোন দেশে জনবহুল শহরের উপর দিয়ে প্রশিক্ষণ বিমান উড়ে আমার জানা নেই। অষ্ট্রেলিয়ায় তো দেখি রয়্যাল অষ্ট্রেলিয়ান এয়ার ফোর্স বেইজ শহর থেকে অনেক দূরে। ধরুন, পাইলট তৌকির যদি প্রশিক্ষণ বিমান যশোরে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ঘাঁটি বা কক্সবাজারে চালাতেন, একটা লোকেরও প্রাণহানি ঘটতো না, পাইলট সেফ এক্সিট নিতে পারতেন আর সর্বোচ্চ অর্ধশতকের পুরোনো বিমানটি ধ্বংস হতো। অথচ এখনো আমরা বলছি বিশ্বের সেরা বিমানেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, ঢাকা শহরে এতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে, তাদের রক্ষায় এয়ারবেজ লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

দুর্ঘটনার সেইদিন শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী মহানুভবতা, সাহসিকতা ও আদর্শের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা আমার জীবদ্দশায় কখনো দেখিনি, শুনিনি। ঘটনাটি সারাবিশ্ব জুড়ে আলোচিত হচ্ছে। মালয়েশিয়ার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম সোশ্যাল মিডিয়ায় এই শিক্ষকের বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, অষ্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন মহলে দেখলাম বিষয়টি মানুষের নজর কেড়েছে, আমার কাছে অনেকে উনার সম্পর্কে জানতে চাইছেন। পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরকে দেখলাম রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হচ্ছে। উনি সামরিক বাহিনীর লোক, এটাই রীতি। তবে শিক্ষকের বেলায় কেন এই কার্পণ্যতা!

অপেক্ষা করছিলাম দেখি এই মহান শিক্ষকের প্রতি দেশ কেমন সম্মান দেখায়। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায় কোনো এক গ্রামে নিভৃতে তাঁকে দাফন করা হল। খুব খারাপ লাগলো, এমনটা তাঁর প্রাপ্য নয়। তখন অষ্ট্রেলিয়ায় রাত এগারোটা, পরেরদিন অফিস আছে সকাল আটটায়। লিখতে বসলাম, হয়তো ঐটায় আমার পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনের সেরা লেখা। রাত একটার দিকে শেষ করে ডেইলি ক্যাম্পাসের ইরফান সাহেবকে পাঠালাম। উনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাবলিশ করে নিউজ লিংক পাঠালেন, মুহূর্তেই সারাদেশে ছড়িয়ে গেল লেখাটি। বলছি না আমার লেখার কারণে এমনটা হয়েছে, আসলে সারাদেশের লোক এমনটা চেয়েছে - একজন মহান শিক্ষক যেন যথাযথ মর্যাদা পায়। পরে জানতে পেরেছি নীলফামারী জেলা ও জলঢাকা উপজেলা প্রশাসন উনার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

মাহরীন চৌধুরী মতো একজন শিক্ষককে সম্মানিত করলে দেশ ও জাতি সম্মানিত হবে। অস্ট্রেলিয়ায় ‘অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া’ পুরস্কার প্রতিবছর দেওয়া হয় যারা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে এবং সেখানে স্কুলের শিক্ষকরা বেশি থাকে কারণ তারা জানে যদি শিক্ষার ভিত্তি শক্ত না হয়, ভবিষ্যতে ভাল কিছু হবে না। যে বিবেচনায় বহু গুণীজনকে 'স্বাধীনতা পুরস্কার' দেওয়া হয়েছে, সেই একই বিবেচনায় শিক্ষক মাহরীন চৌধুরীকে দেশের সর্বোচ্চ এই বেসামরিক পুরস্কারে ভূষিত করা উচিত। দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিকালে আশা করি একজন মহান শিক্ষকের প্রতি সরকার যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। জানি না সরকার আদৌও করবে কিনা, আমাদের দৈন্যতা ঘুচবে কিনা? তবে জীবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত যিনি চেষ্টা করেছেন শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে, তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে, শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় যুগ যুগান্তরে। পরিশেষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করি, 'এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন"। হে মহান শিক্ষক, আপনি জীবন দিয়ে, নিজের সন্তানদের কথা চিন্তা না করে সকল শিক্ষার্থীদেরকে নিজের সন্তান মনে করেছেন, তাদের জীবন বাঁচিয়ে সমগ্র দেশ ও জাতিকে ঋণী করে গেছেন, আপনাকে আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম।

লেখক: কারিকুলাম, ডিজিটাল শিক্ষা ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, মেলবোর্ন, অষ্ট্রেলিয়া
ই-মেইলঃ akhtar.iut@gmail.com