মাইলস্টোনের শিক্ষক মাহরীন চৌধুরীকে কেন জাতীয় সম্মাননা নয়?
- ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৯:২৭
একজন শিক্ষক বেঁচে থাকে তাঁর কর্মে, আদর্শে, সততায়-নিজে চরমভাবে আক্রান্ত হয়েও উনি জীবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে। শিক্ষক তো এমনই হওয়া উচিত, নিজের জীবন দিয়ে পুরো শিক্ষক জাতি, পুরো দেশকে সম্মানিত করে গেছেন-বলছিলাম দুর্ঘটনা কবলিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মহান শিক্ষক মাহরীন চৌধুরীর কথা।
বিমান বাহিনীর ফাইটার জেট মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপর বিধ্বস্ত হলে শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী বের হয়ে যেতে পারতেন, তিনি তা করেননি। শরীরের ৮০ ভাগ পুড়ে গেছে, তাও ব্যস্ত ছিলেন প্রিয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে, অন্তত ২০ জন বাচ্চার জীবন বেঁচে গেছে এই মহান শিক্ষকের জন্যে। মৃত্যুর আগেও উনার স্বামী জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি তো বের হয়ে যেতে পারতে। উনি উত্তর দিয়েছিলেন, এতগুলো বাচ্চাদের রেখে কীভাবে আসি? স্বামী বললেন, তোমার নিজের বাচ্চাদের কথা কি ভুলে গেছো? উনি বলে গেছেন, ওরাও তো আমার বাচ্চা–এই হলো মায়া মমতায় ভরা শিক্ষক। তার এ অবদান স্বীকার করতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে, যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মানুষ জানতে পারে একজন শিক্ষকের মহানুভবতা, যিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন।
আমাদের দেশে শিক্ষকদের মূল্যায়ন এখন আর সেভাবে হয় না, আর হলেও সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ উন্নত বিশ্বে ঘটে তার সম্পূর্ণ উল্টো। আমি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বহু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখেছি। উদাহরণ হিসাবে অস্ট্রেলিয়ার কথা বলি, এসব দেশের সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়জন শিক্ষক আছে, তারা কি করছেন এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত, তারা নিজেরা তাদের কর্মকাণ্ড ঠিক করে। সরকারের মূল চিন্তা উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। যেমন এখন অস্ট্রেলিয়াতে মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকের সংকট চরমে, তাই ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারের ঘুম আরাম, কেউ সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি করে হাইস্কুলে শিক্ষকতায় আসলে ২০-৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত বৃত্তি দিচ্ছে।
আমাদের দেশে মাধ্যমিক, প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হয় তার একটু উদাহরণ দিই। আমি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র হলেও পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করেছি অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ও যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। বাংলাদেশে একটা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়াশোনা করেছি, ওখানে সব ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থাকলেও একটি শিক্ষা বিভাগ আছে। ঐ শিক্ষা বিভাগের প্রধান ছিলেন প্রফেসর শাহজাহান তপন, বাংলাদেশের সবাই তাঁকে পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের লেখক হিসাবে চিনলেও তিনি মূলত শিক্ষাবিদ ছিলেন। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সবাইকে শিক্ষাবিদ বললেও মূলত শিক্ষাবিদ বলতে যারা শিক্ষা বিষয়ে পড়াশোনা ও কাজ করেন তাদেরকে বুঝায়। সেই অর্থে প্রফেসর কামরুল হাসান মামুন একজন পদার্থবিদ আর প্রফেসর শাহজাহান তপন একজন শিক্ষাবিদ। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল প্রফেসর তপনের সাথে কাজ করার।
প্রফেসর শাহজাহান তপন স্যার পিএইচডি করেছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষকদের সেলফ-ইন্সট্রাকশনাল মডিউল নিয়ে। তখন অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষকদের এটা নিয়ে হাসাহাসি করতে দেখতাম। তারা ভাবতেন হাইস্কুলের বিষয় নিয়ে পিএইচডি করে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়? হার্ভার্ডসহ দুনিয়ার যদি টপ ৫০০টা বিশ্ববিদ্যালয়ের লিস্ট করেন, দেখবেন এদের প্রত্যেকের স্কুল, ডিপার্টমেন্ট বা ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন আছে যারা সারা বছর মাধ্যমিক, প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষক তৈরি করেন। সরকারের মনোযোগ এই সেক্টরে সবচেয়ে বেশি। আমাদের দেশে এ কালচারটা নেই বললেই চলে যার ফলে আমাদের শিক্ষার ফাউন্ডেশনটা দুর্বল। তবে ব্যতিক্রম আছে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির এডটেক ইঞ্জিনিয়ারিং বা আইইউটি-ওআইসির টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট।
যাইহোক, মূল কথায় ফিরে আসি। মাহরীন চৌধুরী মতো একজন শিক্ষককে সম্মানিত করলে দেশ ও জাতি সম্মানিত হবে। অস্ট্রেলিয়ায় ‘অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া’ পুরস্কার প্রতিবছর দেওয়া হয় যারা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে এবং সেখানে স্কুলের শিক্ষকরা বেশি থাকে কারণ তারা জানে যদি শিক্ষার ভিত্তি শক্ত না হয়, ভবিষ্যতে ভাল কিছু হবে না। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র শহীদ আবরার ফাহাদকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এ বছর। তাঁর মৃত্যু অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। ও বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০০৭ এ ছিল, আমি ২০০৪ এ ছিলাম তবে বহু আগে, তাই আমার জন্যে বিষয়টা আরো মর্মস্পর্শী ছিল। একজনের সাথে আরেকজনের তুলনা হয় না তারপরও বলবো যে বিবেচনায় আবরার ফাহাদসহ অনেককে ঐ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে বেশি যুক্তি আছে শিক্ষক মাহরীন চৌধুরীকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারে ভূষিত করা। একজন ভাল শিক্ষক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো, একটি সমাজকে বদলে দিতে পারে। দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিকালে আশা করি একজন মহান শিক্ষকের উপর সরকার যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবে। মহান আল্লাহ তায়ালা শিক্ষক মাহেরিন চোধুরীসহ এ দুর্ঘটনায় সকল শহীদদের জান্নাতবাসী করুন, আহতদের দ্রুত আরোগ্যদান করুন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোকে এই শোক সহ্য করার ক্ষমতা দিন (আমিন)।
লেখক: কারিকুলাম, ডিজিটাল শিক্ষা ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, মেলবোর্ন, অষ্ট্রেলিয়া
ই-মেইলঃ akhtar.iut@gmail.com