অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই আমাদের জন্মগত স্বভাব

অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান
অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান © টিডিসি সম্পাদিত

২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি)আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন তাদের পাশে থাকা শিক্ষকদের একজন মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান। পাশাপাশি এ অধ্যাপকের সরব উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। সম্প্রতি তাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের নতুন ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) নিয়োগ দিয়েছে সরকার। আগামী ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করছেন এ অধ্যাপক। পাশাপাশি কথা বলছেন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নানান দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরছেন নিশাত তাসনিম জেসিকা–

জুলাইয়ের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করবেন। আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা, অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়ে
অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান: চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। সেই দিনগুলো ভয়াবহ ছিল। জুলাইয়ের ১৬ তারিখ আবু সাঈদ প্রথম শহীদ হয়েছিলেন। তার সেই মৃত্যুর দৃশ্য দেখে আমরা কেউই বাসায় বসে থাকতে পারিনি। এরপর শিক্ষক-ছাত্র, অভিভাবক সবাই মাঠে নেমেছিলেন। সবাই প্রতিবাদ করেছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। 

প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে। কিন্তু আন্দোলন যতই দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল ততই বেড়েছে। আমাদের একটা জন্মগত স্বভাব আছে— অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। আমরা দেখি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর মুক্তি সংগ্রাম। এটা কিন্তু আমাদের স্বভাবগত একটা বৈশিষ্ট্য যে আমরা ১–২ দিন অন্যায় সহ্য করব, তারপর জীবন দিয়ে হলেও রুখে দাঁড়াবো।

এ বিষয়টাই আমরা দেখেছি চব্বিশের জুলাইতেও। একের পর এক গুলি খেতে দেখেও শিক্ষার্থীদের কেউ পিছপা হয়নি। এটা যে তাদের মন থেকে আন্দোলন ছিল সেটা আমরা তাদের ভাষার মধ্যেই বুঝতে পারি। যখন তারা বলে—“বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।” এটা কিন্তু বাংলাদেশের তরুণদের পক্ষেই সম্ভব। যখন বলে পেছনে পুলিশ, সামনে সাঁজোয়া যান পেছানোর কোনো উপায় নেই। তখনই বোঝা যায় তারা কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিল তারা। তাদের প্রতি আমি আবারও শ্রদ্ধা জানাই।

জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে এবং কতটুকু বাস্তবায়িত হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান: জুলাইয়ের আন্দোলন কিন্তু শুরু হয়েছিল কোটা আন্দোলন দিয়ে। পরবর্তীতে তাদের যখনই দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হল, আস্তে আস্তে তখন এক দফাতে গিয়ে ঠেকেছে এবং সে আন্দোলন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে অন্যায় করবে, জুলুম করবে—তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করা হবে। ৫ আগস্ট একজন স্বৈরাচারীর পতন ঘটার পর আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল যে আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারব, আমরা স্বাধীনতাভাবে চলতে পারব, আমরা নতুনভাবে সবকিছু করব। তবে কতটা করতে পেরেছি সেটা নিয়ে আমার প্রশ্ন রয়ে গেছে।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রসংসদ নির্বাচন আয়োজনের দাবিটি কীভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান: শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রসংসদ কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুসহ অন্যান্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের নির্বাচন দেখতে পাই না। এই নির্বাচন যদি নিয়মিত হয় তাহলে ছাত্রদের মনে একটা ব্যাপার তৈরি হবে যে আমাদের সাধারণ ছাত্রদের কাছেই যেতে হবে। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গেস্টরুম কালচার বা শিক্ষার্থীদের ওপর যে দমন-পীড়ন হয় সেটা যদি বন্ধ করতে চায় তাহলে ছাত্রসংসদের প্রয়োজনীয়তা আছে। জুলাই আন্দোলনের প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। আশাকরি, অচিরেই এই ধরনের নির্বাচন হবে এবং ছাত্ররা ছাত্রদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করবে, কথা বলবে। 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক আলোচনা-বিবেচনা বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে| শিক্ষক রাজনীতির গতানুগতিক ধারা চালু থাকা কতটুকু যৌক্তিক? 
অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান: এটা বলতে আসলে আমার দ্বিধা নেই যে আমরা কেউ ইতিহাস থেকে কিছু শিখি না। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষকদের উচিত ইতিহাস থেকে আরও বেশি শিক্ষা নেওয়া। পূর্বে আমরা দেখেছি, শিক্ষকের যোগ্যতা বা মানদণ্ড না দেখে দলীয় ভিত্তিতে তাকে নিয়োগ করা হয়েছে। এটা কম-বেশি সবাই জানে—এটা একটা ওপেন সিক্রেট।

যাদের দলীয়ভাবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারা অবশ্যই শিক্ষার্থীদের কথা কম ভাববেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা কম ভাববেন এবং দেশের কথা কম ভেবে তার দলীয় স্বার্থ বেশি ভাববেন। এবং তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার কথাই বেশি ভাবেন। আশা রাখছি, এই ধরনের বিষয় থেকে আমরা সরে আসবো এবং শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো রকম আপস করবো না।

মেধার ওপর ভিত্তি করে যেন শিক্ষক নিয়োগ হয় এবং শিক্ষকের মূল দায়িত্ব হবে শিক্ষা প্রদান। তারপর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতামত থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা যেন বেশি প্রাধান্য না পায়। এখান থেকে আমরা শিক্ষা নেব।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ কী কী থাকছে বলে মনে করেন?
অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান: দেশের রাজনীতি নিয়েও আমি একই কথা বলব। ডেমোক্রেসি মানে একেকজনের একেক রকম মতামত থাকবে। তবে চূড়ান্তভাবে সাধারণ মানুষ যাকে চাইবে, যার কার্যক্রম এবং নীতির ওপর মানুষ আস্থা প্রকাশ করবে, তার হাতেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া উচিত। আমরা রাজনীতি করি কার জন্য? দেশের মানুষের জন্য। সেটা যদি মাথায় থাকে তাহলে কিন্তু এত সমস্যা হবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা চিন্তা করি কীভাবে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হবো, কীভাবে দালান হবে, গাড়ি হবে—কিন্তু দেশের মানুষ লাভবান হলো কি না, সেটা নিয়ে আমাদের চিন্তা করার সময় নেই। রাজনীতিবিদদের মনে রাখা উচিত, রাজনীতি একটি মহৎ পেশা। তবে পেশা বলবো না আমি মহৎ কাজ বলবো। কিন্তু রাজনীতিকে যদি আমরা আয়ের উৎস ভাবী তাহলে সেটা কখনো ভালো কিছু হবে না।

সুতরাং প্রথমেই যেটা মাথায় রাখতে হবে সেটা হলো দুর্নীতিমুক্ত থাকা। দুর্নীতিমুক্ত থাকতে হবে দলীয়ভাবে। তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে, সমাজ এগিয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে সেই পুরোনো কথাটা—“ব্যক্তি নয়, দল নয়, দেশের স্বার্থ বড়।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা কি আছে?
অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান: শিক্ষক বলতে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নয়, প্রাইমারি লেভেলের শিক্ষকদের জন্য একটি আলাদা বেতন কাঠামো থাকা উচিত। এমনভাবে যদি আমরা স্যালারি স্ট্রাকচারটা করতে পারি যে আমাদের বেস্ট ছাত্রগুলো প্রাইমারি শিক্ষকের পেশায় যাবেন।
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের তুলনায় একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের অবদান বেশি। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের অবদান অনেক বেশি। তারা রুট সৃষ্টি করে দেন এবং আমরা টারশিয়ারি লেভেলের শিক্ষাদান করে থাকি। শিক্ষকদের বেতন কাঠামো এমন হওয়া উচিত যাতে ভালো শিক্ষার্থীরা এই পেশায় আসতে অনুপ্রাণিত হয়।

শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বাইরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আশপাশের দেশগুলোর দিকে যদি তাকাই, পাকিস্তানকে যদি দেখি—তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে আছে, কিন্তু তারপরও তাদের দেশের শিক্ষকদের বেতনের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের দেশ অনেক বেশি পিছিয়ে আছে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে মেধাবীরা বাইরে গেলে ফিরে আসে না। এখানে দুটো বিষয় আছে—এক, তাদের ব্যক্তিগত আর্থিক সচ্ছলতা এবং দুই, গবেষণা করতে গেলেও তো ফান্ড প্রয়োজন। এই দুইটা বিষয় নিশ্চিত করতে পারলে কে বাইরে গিয়ে থাকবে আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে! এই দুইটা বিষয় নিশ্চিত করতে পারলে তারা অবশ্যই দেশে ফিরে আসবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক আলোচনা-বিবেচনা বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে| শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়ানোর বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? 
অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান: আমাদের অনেক ডেডিকেটেড শিক্ষক আছেন যারা শিক্ষাদান এবং গবেষণার বাইরে যেতে চান না। এটাও ঠিক, আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা রাজনীতিকে মূল পেশা হিসেবে নিয়ে নেন—যেটা হওয়া উচিত ছিল না।

শিক্ষকরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন থাকবেন। তারা নিরপেক্ষভাবে কথা বলবেন। যেমন জুলাই-আগস্টে শিক্ষকরা মাঠে নেমেছিলেন। তারা ক্রান্তি লগ্নে অবশ্যই কথা বলবেন। তবে আমি আশাকরি জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের মাধ্যমে সবার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসবে। শিক্ষার্থীদের মনেও একটা অন্যরকম পরিবর্তন আসবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি বড় অংশ নামমাত্র উপায়ে চলছে। বেশ কিছু ভালোও আছে। এতো বিপুল পরিমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার আছে কি?
অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান: আমি তো আসলে আমার পুরো জীবন কাটিয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমার তেমন একটা ধারণা ছিল না। যখন আমি উপাচার্য হয়ে আসি তখন থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানা।

অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেগুলো সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতার পর্যায়ে চলে এসেছে। আবার অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানের দিক থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর দুটি কারণ—এক ট্রাস্টি বোর্ড বা মালিকপক্ষের মনোভাব এবং দুই ফান্ডিং।

ফান্ড ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ভালোভাবে চলতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু সম্পূর্ণ সরকারি ফান্ডের ওপর নির্ভর করে চলে। সে হিসেবে আমি মনে করি, ইউজিসির মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি ফান্ড আসা উচিত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও দেশের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করছে, বাইরের কেউ তো নেই। তাই সরকারের উচিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ফান্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করা।