ফেনীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, রেখে যাচ্ছে ক্ষতচিহ্ন
- ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩৪
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও পানিতে ডুবেছে ফেনীর জনপদ। টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে জেলার নিম্নাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকাগুলো বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। তবে ধীরে ধীরে কিছু এলাকায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
ফেনীর ছাগলনাইয়া, সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার কিছু অংশে এখনও লোকালয়ে পানি জমে আছে। তবে জেলার অন্য দুই উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। বন্যার কারণে দেখা দিচ্ছে নতুন দুর্ভোগ, ভেসে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। অনেক এলাকায় এখনও খাদ্য ও নিরাপদ পানির সংকট প্রকট, ফলে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় প্লাবিত হওয়া পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার কোথাও কোথাও এখনো পানি রয়েছে। তবে সড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় গন্তব্যে পাড়ি দেওয়া মানুষজনের মনে স্বস্তি ফিরেছে। ফুলগাজী উপজেলায় বন্যার পানি কমলেও, পানি নামছে ধীরগতিতে। এ ছাড়া ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞা এলাকার আংশিক অংশে এখনো পানি নামেনি। এসব এলাকায় কোথাও হাঁটু সমান পানি, আবার কোথাও কোমর সমান পানি রয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে , গত মঙ্গলবার (৮ জুলাই) পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখন নতুন করে ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার কিছু অংশ প্লাবিত হচ্ছে। এতে ১১২টি গ্রামের লাখো মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। জেলায় খোলা ৮৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার মানুষ আশ্রয় নেন, যার মধ্যে ইতোমধ্যে প্রায় ৫ হাজার মানুষ বাড়ি ফিরেছেন। দুর্গত এলাকায় উপজেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে ২৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক ত্রাণ ও সহায়তা কার্যক্রমে কাজ করছেন।
কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, এবারের বন্যায় ২ হাজার ৩৫০টির বেশি মৎস্য ঘের ও পুকুর এবং ১ হাজার ৬৫৫ হেক্টর আমন বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়াও বন্যায় এখন পর্যন্ত পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় প্রাণিসম্পদে ৬৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৫০ টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পুরোপুরি পানি নেমে যাওয়ার পরই ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত পরিমাণ তুলে ধরা হবে বলে জানান তারা।
পরশুরাম উপজেলার বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিনের সঞ্চয় খরচ করে একটা ঘর তুলেছিলাম। স্বপ্ন ছিল পরিবারের জন্য একটু নিরাপদ আশ্রয় হবে। কিন্তু বাঁধ ভাঙার পর সে স্বপ্নও পানিতে তলিয়ে গেল। ঘরটা চোখের সামনে ডুবে যেতে দেখেছি, কিছুই করতে পারিনি।’
ফুলগাজী উপজেলার উত্তর শ্রীপুর এলাকার বাসিন্দা আজহার ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবারই বাঁধ ভাঙে, পানি আসে, তারপর সবাই আশ্বাস দেয়। কিন্তু বছর ঘুরলেই সেই বাঁধ আর নেই। এবার তো পানি নামতেই চায় না। আমরা শুধু টেকসই একটা বাঁধ চাই যেটা আমাদের বারবার ডুবতে দেবে না।’
ছাগলনাইয়া উপজেলার রাধানগর এলাকার বাসিন্দা আছমা আক্তার বলেন, ‘গত দুইদিন ধরে আমরা পরিবারসহ আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। পানি একটু কমায় আজ সকালে বাড়িতে ফিরে এসেছি। কিন্তু ফিরে এসে দেখি, ঘর-বাড়ি সব এলোমেলো। মেঝেতে কাদাপানি, আসবাবপত্র অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এখনো উঠানে পানি, ঠিকমতো হাঁটাচলার উপায় নেই। খাবার, বিশুদ্ধ পানি সব কিছুরই অভাব। শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, আর আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি। এই দুর্ভোগ থেকে কবে মুক্তি মিলবে, জানি না।’
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘জেলায় টানা পাঁচ দিন ধরে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত ছিল। তবে শুক্রবার সূর্যের দেখা মিলেছে। তারপর থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ রয়েছে।’
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘পরশুরাম, ফুলগাজী অংশে নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর অংশে পানি কিছুটা বেশি। বাঁধের ভাঙনের স্থান দিয়ে এখনো পানি ঢুকছে। পানি কমার পরেই বাঁধ মেরামতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এ ব্যাপারে ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জেলায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সাড়ে ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে শুকনো খাবার, গো-খাদ্য ও শিশু খাদ্যের আরও আরও ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।’
এদিকে, শনিবার (১২ জুলাই) সকালে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে এসেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক। এর আগে শুক্রবার রাতে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।