সোহাগ হত্যার ক্ষতিপূরণ বিএনপিকে দিতে হতে পারে চরম মূল্য দিয়ে

রাজু নূরুল
রাজু নূরুল © টিডিসি সম্পাদিত

পুরান ঢাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে বিএনপির কর্মীরা যে নির্মম কায়দায় হত্যা করেছে—ঘটনার রেশ সহজে মুছে যাবে না। জনগণ হয়ত একসময় ভুলে যেতে চাইবে, কিন্তু ইতিহাস তাদের ভুলতে দেবে না। সোহাগ হত্যার রাজনৈতিক ক্ষতিপূরণ বিএনপিকে দিতে হতে পারে চরম মূল্য দিয়ে।

আওয়ামী লীগ যেমন বিশ্বজিৎ ও আবরার হত্যার দায় বইতে হয়েছে, তেমনি বিএনপিকেও সোহাগ হত্যার দায় নিতে হবে। আওয়ামী লীগ অন্তত সাংগঠনিকভাবে ক্ষত সামলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পেরেছে, কিন্তু বিএনপির সেই কৌশলগত সক্ষমতা আছে কি না, সেটিই এখন প্রশ্ন। আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণে, বিএনপির জন্য এই ক্ষতি সামলানো কঠিনই হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে ‘সাধারণ ছাত্রদের’ ব্যানারে বিশাল মিছিল বের হয়েছে। মিছিল থেকে তারেক রহমানকে অশ্লীলভাবে গালিগালাজ করা হয়েছে। এটা থেকে বুঝলাম, মিছিল ‘সাধারণ ছাত্রদের’ ব্যানারে হইলেও আসলে এটা সেই পুরোনো পন্থা। এরা মূলত লুঙ্গির তলায় থাকা শিবির আর তাদের বি টিম এনসিপি। সোহাগ মরলে এদের কিছু যায় আসে না, যায় আসলে এরা সোহাগের হত্যার বিচার চাইত, তারেক রহমানকে গালি-গালাজ করত না।

এটা মেনে নেন যে, সাংগঠনিকভাবে এই শিবির আর এনসিপিকে সামলানোর ক্ষমতা ছাত্রদলের নাই। গত ১৬ বছর বিএনপি ছাড়া বাকি সবাই বাংলাদেশে রাজনীতি করেছে। বিএনপি বা ছাত্রদল কোথাও দাঁড়াতে পারে নাই। ছাত্রদলের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে! কিন্তু শিবির লীগের সাথে মিশে গিয়ে তার কার্যক্রম পুরাদমে চালিয়ে গেছে। সদস্য বাড়িয়েছে। বড় বড় কয়টা নেতার ফাঁসি ছাড়া তৃণমূলে তাদের টিকিটি স্পর্শ করছে কেউ, এমন প্রমাণ নেই।

জামায়াত-শিবিরের উৎপাদন সেন্টার মাদ্রাসাগুলা তো আছেই। গত ১৬ বছরে এই দেশের আনাচে-কানাচে শহরে-বন্দরে হাজার হাজার মাদ্রাসা হয়েছে। সেসব মাদ্রাসায় অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের নেতারা। তাদের নেতারা বেহেশতে যাওয়ার লোভে বাপ-মা, নিজের নামে মাদ্রাসা বানিয়েছেন। সেসব মাদ্রাসায় যারা পড়ান, তাদের অধিকাংশই জামায়াত-শিবির! ছাত্রছাত্রীর উপর শিক্ষকের বিরাট প্রভাব থাকে, যার ফলে তারা ছাত্র-ছাত্রীদের প্রভাবিত করেছেন বিভিন্নভাবেই।

আওয়ামী লীগ মাঠে থাকলে জামায়াত আর তাদের বি টিম এনসিপিকে সামলাতে পারতো। কিন্তু আগেই সেই সুযোগ সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। বিএনপিকে দিয়ে লীগকে নিষিদ্ধ করিয়েছে। হাসনাত আর শ'দুয়েক শিবির কর্মীর ‘শাহবাগ দখল’ দিয়ে লীগ নিষিদ্ধ হয় নাই, লীগ নিষিদ্ধ হয়েছে যখন বিএনপি সেখানে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে।

অন্যদিকে, ১৬ বছর পর ছাড়া পেয়ে বিএনপির পাতিপুতি নেতারা পাগল হয়ে গেছেন। দলের সেন্ট্রাল কমান্ড এদেরকে সামলাতে পারে নাই। গ্রামে-গঞ্জে এরা বিএনপির নামে যা করছে, সেই সব শুনলে গা শিউরে উঠে। আর সরকার খুব কৌশলে এই সুযোগটা তৈরি করে দিয়েছে। কীভাবে?

গত ১০ মাস অপরাধীদেরকে তারা গ্রেফতার করে নাই। উল্টো বিএনপির আগের আমলের যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী জেলে ছিল, তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে। যারা দেশের বাইরে ছিল তাদেরকে দেশে ঢুকতে দিয়েছে। আর বাজারে তো লুট হওয়া অস্ত্র আছেই।

বিএনপি এটাকে তাদের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা ভাবছে। ভাবছে, আরে সরকার তো আমার কথা শোনে! ভাবছে, সরকার তাদের হাতে আছে। মূলত এটা ছিল টোপ। সেই টোপ গিলছে বিএনপি। এখন গলায় আটকানোর পর হাঁসফাঁস করছে।

সন্ত্রাসীরা যখন মাঠেঘাটে অ্যাক্টিভ হয়েছে, তখন খুন, রাহাজানি, চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই নাম আসতেছে বিএনপির। এরপর প্রতিটা হত্যার ঘটনা সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার পাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের জন্য সরকারের বট-বাহিনীতো ওঁতপেতে আছেই। গত জুলাই-আগস্টে যে বিশাল অনলাইন বাহিনী দুর্দান্ত সব ফটোকার্ড, ছোট ছোট রিলস, স্লোগান বানানোর কাজ করেছে, তারা সক্রিয় হয়ে গেছে।

বছর ঘুরে যখন আরেকটা জুলাই এলো, গত জুলাইয়ের আবেগ যখন মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তখন বিএনপির মত বিরাট একটা দল নিজেদের ঘর সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, সিজনাল পাখিরা যখন তাদের ঘরে ঢুকে কিচিরমিচির করছে, ততদিনে জামাত ২৯৬ আসনে প্রার্থী ঠিক করে ফেলছে। সরকারের যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যবহার করে কিংস পার্টি তার সাংগঠনিক শক্তিকে বাড়িয়ে নিচ্ছে। সারা দেশে পিকনিকের আমেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটছে।

জুলাইয়ের এই আবেগ আগস্ট পর্যন্ত চলতে থাকবে। কেন যেন মনে হচ্ছে, এই দেড় মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যাপকভাবে পাল্টে যাবে। জুলাই হয়ে যাবে বিএনপির জন্য দীর্ঘ এক মাস।

ওয়েল ডান ইন্টেরিম। ইউ প্লেইড ভেরি ওয়েল!

রাজু নূরুল: লেখক, অনুবাদক ও বেলজিয়ামে পিএইচডি গবেষক 
যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com