এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাইনি, কিন্ত এটা আমার স্বপ্নকে থামিয়ে রাখতে পারেনি
- ১২ জুলাই ২০২৫, ১৭:৩১
অনেক শিক্ষার্থীই ভাবে—জিপিএ-৫ না পেলে জীবনে সফল হওয়া সম্ভব নয়। সেই ভুল ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাহসিকতার সঙ্গে নিজের পথ তৈরি করে নিয়েছেন মো. রাশিদুল ইসলাম। এসএসসিতে জিপিএ-৫ না পাওয়ার পর শুনেছেন কটু কথা, বাঁচতে হয়েছে মানসিক কষ্ট নিয়ে। কিন্তু হতাশ না হয়ে নিজের চেষ্টা ও আত্মবিশ্বাস দিয়েই তিনি আজ মালয়েশিয়ার আলবুখারী ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ফুল-ফান্ডেড স্কলারশিপে পড়াশোনা করছেন।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন—স্বপ্ন হারিয়ে না ফেলে ধাপে ধাপে কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, কীভাবে হতাশা জয় করে উচ্চশিক্ষার সিঁড়িতে পা রেখেছেন। তার এই গল্প নিঃসন্দেহে হয়ে উঠবে হাজারো তরুণের অনুপ্রেরণার উৎস।
ডেইলি ক্যাম্পাস: এসএসসি পরীক্ষায় আপনার ফলাফল কেমন হয়েছিল? তখন কী অনুভব করেছিলেন?
মো. রাশিদুল ইসলাম: আমার দাখিল/এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ছিল ৪.৮৯। প্রথমে একটু খারাপ লাগলেও আমি সন্তুষ্ট ছিলাম, কারণ আমি নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। সেই সময়টা আমার জীবনে ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক, এই ফলাফলের পর আমি কুমিল্লা থেকে বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টঙ্গীর তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হই।
ডেইলি ক্যাম্পাস: জিপিএ-৫ না পাওয়ার কারণে কী ধরনের মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন চারপাশ থেকে?
মো. রাশিদুল ইসলাম: দাখিল/এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পাওয়ায় আশপাশের অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। বিশেষ করে কাছের আত্মীয়দের কেউ কেউ বলেছিলেন, ‘তুমি তো জীবনে কিছুই করতে পারবে না।’
আবার কেউ কেউ বলেছিলেন, ‘কী পড়াশোনা কর, জিপিএ-৫ পাও না?’ এমন কথা শুরুতে খুব কষ্ট দিলেও আমি সেগুলোকে নিজের অনুপ্রেরণায় রূপান্তর করেছি। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি প্রমাণ করব—জিপিএ-৫ না পাওয়া মানে থেমে যাওয়া নয়।
ডেইলি ক্যাম্পাস: তখনকার সেই হতাশা বা চাপ আপনি কীভাবে মোকাবিলা করেছিলেন?
মো. রাশিদুল ইসলাম: এসএসসির ফল প্রকাশের পর এক ধরনের মানসিক চাপ অনুভব করেছিলাম, কারণ নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত জিপিএ পাইনি। কিন্তু আমি নিজেকে বুঝিয়েছি—এটি কোনোভাবেই শেষ নয়, বরং এটি শেখার একটি সুযোগ। এরপর এইচএসসিতে আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি এবং আলহামদুলিল্লাহ, সেখানে জিপিএ-৫ অর্জন করি। এই অর্জন আমাকে নতুন করে আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। পাশাপাশি সময় পেলেই আইটি স্কিল ও উচ্চ শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে জানার চেষ্টা করেছি—নিজেকে শুধু পরীক্ষার ফলাফলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখিনি।
ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার জীবনের এই পরিবর্তন কীভাবে এলো?
মো. রাশিদুল ইসলাম: পরিবর্তন এসেছে ধাপে ধাপে, তবে প্রতিটি ধাপই ছিল আমার জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসএসসি পরীক্ষার পর এইচএসসিতে ভালো ফল করে আমি আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। এরপর উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুঁজতে নিজ উদ্যোগে স্কলারশিপ খুঁজেছি, IELTS পরীক্ষা দিয়েছি, SOP ভালোভাবে তৈরি করেছি এবং অভিজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করেছি। এই পুরো প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়েই আমি বুঝতে পেরেছি—পরিশ্রম কখনোই বৃথা যায় না।
ডেইলি ক্যাম্পাস: মালয়েশিয়ায় পড়ার সুযোগ কীভাবে পেলেন?
মো. রাশিদুল ইসলাম: ছোটবেলা থেকেই স্কলারশিপের মাধ্যমে বিদেশে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখতাম। এসএসসি ও এইচএসসি শেষে বিভিন্ন স্কলারশিপে নিজে নিজেই আবেদন করতে থাকি। প্রাথমিকভাবে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পেলেও আমি হাল ছাড়িনি। পরে IELTS পরীক্ষা দিই, এবং SOP (Statement of Purpose) আরও নিখুঁতভাবে লিখে সিনিয়রদের পরামর্শ নিই। দ্বিতীয় দফায় ২০টিরও বেশি স্কলারশিপে আবেদন করি, যার মধ্যে ৫টি থেকে ইতিবাচক সাড়া পাই। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমি Albukhary International University (AIU), Malaysia থেকে প্রাপ্ত ফুল-ফান্ডেড স্কলারশিপ গ্রহণ করি, যেখানে টিউশন ফি, আবাসন ও মাসিক স্টাইপেন্ড সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি আমার জন্য একটি অসাধারণ সুযোগ ছিল।
ডেইলি ক্যাম্পাস: যেসব যোগ্যতা বা দক্ষতা স্কলারশিপ পেতে আপনাকে সাহায্য করেছে সেগুলো কী কী?
মো. রাশিদুল ইসলাম:
*IELTS স্কোর অর্জন;
*ভালোভাবে SOP লেখা ও সিনিয়রদের রিভিউ নেওয়া;
*এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস (যা প্রোফাইলে ভ্যালু অ্যাড করেছিল);
*অনলাইন গ্রুপ ও অনলাইন থেকে হায়ার স্টাডিবিষয়ক তথ্য সংগ্রহ;
*নিজে নিজে চেষ্টা করে ২০টিরও বেশি স্কলারশিপে আবেদন;
*হাল না ছেড়ে ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া;
ডেইলি ক্যাম্পাস: জিপিএ-৫ না পাওয়ার কারণে হতাশায় খারাপ পথ বেছে নেওয়াকে কি যৌক্তিক মনে করেন?
মো. রাশিদুল ইসলাম: একদমই যৌক্তিক না।
আমি নিজেই এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাইনি। কিন্তু সেই একটা জিপিএ আমার স্বপ্ন দমিয়ে রাখতে পারেনি। একজন শিক্ষার্থীর মূল শক্তি হলো চেষ্টা, লক্ষ্য, আর ধৈর্য। গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে কখনোই হতাশায় ডুবে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।
ডেইলি ক্যাম্পাস: জিপিএ-৫ না পাওয়াটা আপনার লক্ষ্য পূরণে কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় কিনা?
মো. রাশিদুল ইসলাম: না, একদমই না। আমি জিপিএ-৫ না পেয়েও ফুল-ফান্ডেড স্কলারশিপে বিদেশে পড়ছি। অবশ্যই ভালো জিপিএ সাহায্য করে, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়।
অন্যদিকে IELTS, SOP, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস, আত্মবিশ্বাস—এসবও বড় ভূমিকা রাখে।
ডেইলি ক্যাম্পাস: এইচএসসিতে যাদের কাঙ্ক্ষিত ফল হয়নি, তাদের জন্য আপনার বার্তা কী হবে?
মো. রাশিদুল ইসলাম: একটা ফলই সবকিছু না। আমি বলব, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুন। আপনাকে নিজের দুর্বলতা চিহ্নিত করে সেখানে কাজ করতে হবে। ভালোভাবে স্কিল বাড়ান এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ খুঁজুন।
আপনার পরিশ্রম একদিন ফল দেবে—আমার মতো আপনিও হয়তো ভবিষ্যতে বলবেন, ‘ভাগ্য নয়, চেষ্টা আমাকে পৌঁছে দিয়েছে এখানে।’