১১ জুলাই: ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ—শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার নির্দেশ

 ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা
‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা © টিডিসি সম্পাদিত

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে ২০২৪ সালের ১১ জুলাই, বৃহস্পতিবার, টানা চতুর্থ দিনের মতো দেশজুড়ে পালিত হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। তবে পূর্ব ঘোষিত এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশি বাধা, লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেলের মাধ্যমে দমন করার অভিযোগ ওঠে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। 

পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী বিকেল তিনটার পর রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে শিক্ষার্থীরা সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করতে উদ্যোগ নিলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন তারা। বৃষ্টির কারণে ঢাকায় মিছিল কিছুটা বিলম্বে শুরু হয়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। এর আগেই শাহবাগ মোড় ঘিরে অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য। জলকামান ও সাঁজোয়া যান ছিল প্রস্তুত।

শাহবাগ মোড়ের ব্যারিকেড অতিক্রম করে বিকেল পাঁচটার দিকে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মেট্রো স্টেশনের নিচে অবস্থান নেন। এসময় তারা ‘ভয় দেখিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’, ‘হামলা করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে পুলিশের পক্ষ থেকে লাঠিচার্জ এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়।

আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলনকারীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান ওবায়দুল কাদেরের

শুধু রাজধানী নয়, সেদিন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজেও ছাত্রদের ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ছড়িয়ে পড়ে। বিকেল ৪টায় শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় গেটের সামনে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে, এতে আহত হন অন্তত ১০ জন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে তালা দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, কিন্তু তারা তালা ভেঙে মিছিল নিয়ে শাহবাগে পৌঁছান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত অবস্থান নেন।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত হন অন্তত ৩০ জন। গুরুতর আহত নয়জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয় স্থানীয় হাসপাতালে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপরও পুলিশ লাঠিচার্জ করে, এতে সাতজন আহত হন। পরে তারা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নগরীর ২ নম্বর গেটে এসে সড়ক অবরোধ করেন। একই সময়ে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল করে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে অবস্থান নিতে চাইলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন এবং লাঠিচার্জে পাঁচজন আহত হন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবরোধ করেন ঢাকা-রাজশাহী রেলপথ। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকাগামী কুয়াকাটা মহাসড়কে অবস্থান নেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়কে এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুলনার জিরো পয়েন্টে অবস্থান করে কর্মসূচি পালন করেন। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা যথাক্রমে যশোর-রাজশাহী মহাসড়ক, গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া সড়ক ও পাবনা-ঈশ্বরদী মহাসড়ক অবরোধ করেন।

আরও পড়ুন: ঢাবিতে জড়ো হচ্ছেন কোটা আন্দোলনকারীরা, অবস্থান নিচ্ছে ছাত্রলীগও

এই হামলা ও দমন-পীড়নের প্রতিবাদে আন্দোলনের আয়োজকরা পরদিন শুক্রবার (১২ জুলাই) সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করার ঘোষণা দেন। তারা বলেন, লাঠি ও গ্যাসে নয়, সমতার দাবিতে ছাত্রসমাজ মাঠে থাকবে।

তবে সরকারের বিভিন্ন মহল আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিক রূপান্তর’ করার অভিযোগ তোলে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা বাংলা ব্লকেড নামে মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। এই আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়ার চেষ্টা করছে।’

২০২৪ সালের ১১ জুলাই (বুধবার) দুপুরে রাজধানী ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী মাসের (আগস্ট) প্রথম সপ্তাহে সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে কোটা সংস্কার মামলা। এ পর্যন্ত মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে এমন কর্মসূচি বন্ধ করে আদালতের নির্দেশ মেনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, আদালত (আপিল বিভাগ) কোটা সংস্কার নিয়ে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারি করেছেন। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ক্লাসে ফিরে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের নির্দেশনা দিয়েছেন। সেতুমন্ত্রী বলেন, আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আদালত বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেবেন এমন আশা প্রকাশ করেন তিনি।

আরও পড়ুন: মহাখালীতে সড়ক অবরোধ তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘অনেকেই শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। তারা যেন এই ষড়যন্ত্রে না পড়ে। জানমালের ক্ষতি হলে, জনদুর্ভোগ ঘটলে পুলিশ বসে থাকবে না।’ একইদিন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে, ‘চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দিতে কিছু মহল সক্রিয়।’

এদিন শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের চিঠি পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। আন্দোলন বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে, এই একই দিনে হাইকোর্ট ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অংশ প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়—সরকার চাইলে কোটার হার, পরিমাণ, পরিমার্জন বা পরিবর্তন করতে পারে; তবে পুরোপুরি বাতিল করতে পারে না।