ড. ইউনূসের অনুজ মুহম্মদ জাহাঙ্গীর: মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি
- ১১ জুলাই ২০২৫, ১৮:০৭
খ্যাতিমান সাংবাদিক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মুহম্মদ জাহাঙ্গীরের উপস্থাপনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘অভিমত’ অনুষ্ঠানটি কবে ও কখন শুরু হয়েছিল মনে নেই। আমি প্রযোজনার দায়িত্ব পাওয়ার আগেই বেশ কয়েকটি পর্ব প্রচারিত হয়ে গেছে। সমসাময়িক সময়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, প্রতিবেদন এবং তর্ক-বিতর্ক ছাড়াও লাইভ অনুষ্ঠানে দর্শকদের প্রশ্নের উত্তরসহ সেই সময় অভিমত ছিল বেশ জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান। নানা ধরনের টেকনিক্যাল ইনভল্ভমেন্টসহ এই জটিল অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা এবং প্রযোজনার দিকটাও ছিল বেশ কষ্টসাধ্য ও ঝামেলাপূর্ণ।
প্রথমদিন প্রযোজনার দায়িত্ব নিয়ে সরাসরি সম্প্রচারের প্যানেলে বসেই লক্ষ করেছি, মুহম্মদ জাহাঙ্গীর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে স্টুডিওর উপস্থিতি এবং বাইরে থেকে টেলিফোনে আসা প্রশ্নোত্তর-পর্ব বেশ সাবলীলভাবে সামাল দিয়েছেন। তবে অনুষ্ঠান প্রচারের মধ্যে একটি বিষয় কয়েকবারই আমার কানে পীড়া দিয়েছে, তা হলো তাঁর বেশকিছু উচ্চারণ! পত্র পত্রিকায় লেখালেখি এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সূত্রে মুহম্মদ জাহাঙ্গীরের সাথে পূর্ব পরিচয় ছিল। অভিমত অনুষ্ঠানের সূত্রে সেই যোগাযোগ ঘনিষ্টতর হয়েছে, তারপরেও তাঁর উচ্চারণ সম্পর্কিত বিষয়টি নিয়ে কথা বলার ব্যাপারে আমি একটু দ্বিধান্বিত ছিলাম।
বিটিভির একটি জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের মানের কথা বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত দু-একটি উচ্চারণের কথা জাহাঙ্গীর ভাইকে বলেই ফেললাম। তিনি বিষয়টা সহজভাবে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, 'জানেন তো আমরা চাটগাঁইয়া মানুষ, আমাদের জন্যে সব সময় প্রমিত বাংলা উচ্চারণ করা বেশ কঠিন। তারপরেও চেষ্টা করবে।' তিনি কথা রেখেছিলেন। পরবর্তী অনুষ্ঠানগুলো এবং আরো পরে অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি তিনি অনেক উচ্চারণ শুদ্ধ করে ফেলেছেন।
মুহম্মদ জাহাঙ্গীর সেন্টার ফর ডেভলমেন্ট কম্যুনিকেশন নামে একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতি বছরই প্রামাণ্যচিত্র এবং মোটিভেশনাল টিভিস্পটসহ সিডিসি'র বেশ কিছু অডিও ভিজ্যুয়াল প্রডাকশনের কাজ থাকতো। জাহাঙ্গীর ভাই তাঁর পরিচিতি ও যোগ্যতা দিয়ে অনেক কাজ নিয়ে আসতেন, কিন্তু তাঁর নিজের পক্ষে সময় মতো রেকর্ডিং এডিটিং করে এসব কাজ সম্পন্ন করা প্রায় কখনোই সম্ভব হতো না। ফলে আমি এবং আমার বন্ধু ও সহকর্মীদের অনেকেই তাঁর হয়ে প্রামাণচিত্র বা টিভিস্পট তৈরি করে দিয়েছি। তিনি তাঁর ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণ করে আমাদের যথাযথ সম্মানী বা পারিশ্রমিক দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়ন সম্পর্কিত একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্যে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে আমরা চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। চিত্রগ্রাহক ছিলেন জিয়া ভাই, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রধান চিত্রগাহক প্রয়াত জিয়াউল হক। রাতে আমরা শ্যুটিংটিমের সকলেই একটি হোটেলে অবস্থান করলেও জাহাঙ্গীর ভাই ছিলেন তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে। তবে যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন, 'সকালে হোটেলে নাস্তা করবেন না, মাইক্রোবাস এলে আপনারা সরাসরি বাসায় চলে আসবেন, নাস্তা করে আমরা চিটাগাং পোর্টের দিকে যাবো।'
জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সেই প্রাতরাশের সুযোগে দেখা হয়ে গেল তাঁর পিতা দুলা মিয়া সওদাগরের সাথে। তাঁর বয়স তখন পঁচাশি বা আরো একটু বেশি। তিনি আমাদের খোঁজ খবর নিলেন এবং সাবলীল ভাবে কথা বললেন। ২০০০ সালে নব্বই বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হয়েছেন।
যদিও ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবুও বলে রাখি, সেদিন আমরা একটি ছোট লাইটারেজ জাহাজ নিয়ে সমুদ্রের ভেতরে অনেকটা দূরে একটা বড় জাহাজ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেদিন সমুদ্র ছিল ভীষণ উত্তাল, প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে প্রতি মুহূর্তেই লাইটারেজ উলে্ট যাবার সম্ভাবনা ছিল। ষাটোর্ধ জিয়া ভাই এবং চাটগাঁইয়া পোলা জাহাঙ্গীর ভাই বেশ নিশ্চিন্ত থাকলেও আমি শারীরিকভাবে কাহিল এবং মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। যাই হোক, সম্ভবত পুণ্যবান দুলা মিয়া সওদাগরের দোয়ার বরকতে আমরা সেদিন শ্যুটিং শেষ করে সহি সালামতে ফিরে এসেছিলাম।
২০০১ সালে বিএনপির রাজত্বকাল শুরু হলে মুহম্মদ জাহাঙ্গীরের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে তাঁর সাথে দেখা সাক্ষাৎ এবং যোগাযোগও কমে গিয়েছিল। তবে পত্র পত্রিকায় আমার কোনো লেখা প্রকাশিত হলে ফোন করতেন। বিশেষকরে গণমাধ্যম সম্পর্কিত কোনো লেখা থাকলে অবশ্যই কথা বলতেন, উৎসাহিত করতেন এবং অনেক সময় তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করতেন। এ ছাড়া সিডিসির সেমিনার বা কোনো কোনো মিটিংএও ডেকেছেন।
মুহম্মদ জাহাঙ্গীরের বড় ভাই ড. মুহম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে একদিন মগবাজার মোড়ে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে দেখা। সিডিসির অফিসও মগবাজার মোড়ের কাছেই। বললেন, ‘একদিন অফিসে আসেন। বড়ভাই নতুন রাজনৈতিক দল করছেন। আপাতত সিডিসি অফিসেই তাঁর অফিস।’
আমি বললাম, 'নোবেল পুরস্কারের মতো এতো বড় একটা সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছে যাবার পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসা তাঁর জন্যে কী খুব একটা সুখকর হবে!' জাহাঙ্গীর ভাই বললেন, 'আমরাও সে কথা বলেছি। কিন্তু ভাই সম্ভবত দেশের মানুষের জন্যে কিছু একটা করতে চান এবং সেটা রাজনীতি ছাড়া সম্ভব নয়। সেই জন্যেই দল গঠন করেছেন, দেখা যাক...।'
একদিন আমি সত্যিই নোবেল লরিয়েটের পার্টি অফিস দেখতে মগবাজারে সিডিসি অফিসে হাজির হলাম। কিন্তু যেমনটা আশা করেছিলাম, তেমন কিছুই দেখলাম না। প্রায় জনমানবহীন দপ্তরে শুনসান নীরবতা। জাহাঙ্গীর ভাই বললেন, ‘বড় ভাইয়ের মতো মানুষের পক্ষে বাংলাদেশে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। পার্টি ভেঙে দিয়ে উনি আবার বিদেশে চলে গেছেন।’
বললাম, ‘আমি আগে থেকেই জানতাম রাজনীতি তাঁর জন্যে নয়। বিদেশে অধ্যাপনা এবং পাশাপাশি অর্থনীতি বিষয়ক লেখালেখি করাটাই মনে হয় সবচেয়ে ভালো কাজ হতে পারে।’
মুহম্মদ জাহাঙ্গীর অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন ২০১৯ সালের ১০ জুলাই। তিনি বেঁচে থাকলে দেখতে পেতেন তাঁর ভাই সূক্ষ্ম নীল নকশার (Meticulous design) মাধ্যমে কীভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দক্ষ খেলোয়াড় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক কূটচালে বাঘা বাঘা রাজনৈতিক নেতা কুপোকাৎ। আজ তিনি বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে ডিসাইডিসভ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আফসোস, মুহম্মদ জাহাঙ্গীর তাঁর অগ্রজের এই উল্লম্ফন দেখে যেতে পারলেন না।
মৃত্যু দিবসে জাহাঙ্গীর ভাইেয়র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।
ফরিদুর রহমান: লেখক ও প্রাবন্ধিক