১০ জুলাই: বাংলা ব্লকেডে সারাদেশ স্থবির, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা
- ১০ জুলাই ২০২৫, ১৪:৫৮
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ২০২৪ সালের ১০ জুলাই (বুধবার) সারাদেশে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেওয়া শিক্ষার্থীরা।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে এদিন রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি বিভাগীয় ও জেলা শহরে শিক্ষার্থীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে ব্যাপক বিক্ষোভ করেন। এতে কার্যত সারা দেশের স্বাভাবিক যোগাযোগব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় রেল, গণপরিবহন, ব্যক্তিগত পরিবহনসহ সর্বত্র যাতায়াত।
ঢাকায় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দু ছিল শাহবাগ মোড়। সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে লাইব্রেরি চত্বরে জমায়েত হন শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে মিছিল সহকারে শাহবাগে এসে অবস্থান নেন। আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও সড়ক অবরোধ করেন। বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, ইন্টারকন্টিনেন্টাল, মৎস্য ভবন, চানখাঁরপুল, বঙ্গবাজারসহ অন্তত ২৫টি পয়েন্টে শিক্ষার্থীদের স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে রাজধানী।
আরও পড়ুন: কোটা সংস্কার আন্দোলনের চিত্র ধারণ করতে গিয়ে নিহত হন রাব্বী
ঢাকার বাইরেও ছিল একই চিত্র। রাজশাহীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করেন। চট্টগ্রামের দেওয়ানহাট মোড়ে অবস্থান নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কে অবস্থান নেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
ময়মনসিংহে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে অবস্থান নেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পটুয়াখালী-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা। পাবনা, কুমিল্লা, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ সমাবেশ ও গণসংযোগে অংশ নেন।
এদিকে বেলা সাড়ে ১১টায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মোড় আসে, যখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের ২০১৮ সালের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের ওপর এক মাসের ‘স্থিতাবস্থা’ জারি করে। এই রায়ের ফলে ২০১৮ সালের পরিপত্র আবার কার্যকর রইল, অর্থাৎ আপাতত কোটা পদ্ধতি ফিরছে না। আগামী ৭ আগস্ট পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়। রায়ের পর প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বন্ধ করে ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
আরও পড়ুন: রায়হানের গুলি খাওয়ার দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা
কিন্তু শাহবাগ মোড়ে বিকেল সাড়ে ৭টায় এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মানেনি। আদালতের স্থিতাবস্থা রায় মানেই সমাধান নয়। আমরা আমাদের এক দফা আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাব। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সারাদেশে আবারও বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শাহবাগ মোড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে মিছিল শুরু করব এবং সারাদেশের শিক্ষার্থীরা স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নেবেন।’
এই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে এক ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ঢাকার নূর হোসেন চত্বরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টা থেকেই যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। কারওয়ান বাজার রেললাইন অবরোধ করে রেল চলাচল পুরোপুরি স্থবির করে দেন আন্দোলনকারীরা। এক ঘণ্টার অবরোধেই দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা দেশের রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করেন, তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা মহাখালীতে অবস্থান নেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবরোধ করেন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক।
আরও পড়ুন: সরকার পদত্যাগের পরও থামেনি গুলি—মিরপুরে প্রাণ হারালেন শাহাদাত
এদিকে বুধবার চতুর্থ দিনের মতো দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ‘ছাত্র ধর্মঘট’ পালন করা হয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি বারবার আহ্বান জানান ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। রাজপথে আন্দোলন করে এ ইস্যুর সমাধান হবে না।’ তিনি শিক্ষার্থীদের কষ্ট না দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানান।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট কোটা সংক্রান্ত বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে এবং স্থিতাবস্থা জারি করেছে, তাই আন্দোলনের আর যৌক্তিকতা নেই। ছাত্রদের উচিত ঘরে ফিরে যাওয়া।’
তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, এই স্থিতাবস্থা কেবল সময়ক্ষেপণ। তাদের এক দফা দাবি—৫ শতাংশের বেশি কোটা নয়, বাকিগুলো বাতিল করে একটি আইন পাশ করতে হবে—এবং সেই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।