জীবিকার খোঁজে চাকরি করতে গিয়েছিল ফজর, গণতন্ত্র রক্ষায় লাশ হয়ে ফিরল
- ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৪:৫১
গত বছরের আগস্ট। ঢাকার রাজপথে তখন ঢেউয়ের মতো ছুটে চলছে কোটা সংস্কার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ তখন রাস্তায়। কেউ শিক্ষার্থী, কেউ শ্রমিক, কেউ গার্মেন্টস কর্মী। তাদেরই একজন ছিলেন জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার টাংগারিপাড়া গ্রামের ছেলে মো. ফজর মিয়া।
মাত্র ২৬ বছরের তরুণ। জন্মেছিলেন টাংগারিপাড়ার শাহ আলম ও জুলেখা বেগমের ঘরে। পিতা ছিলেন কৃষক, মাতা গৃহিণী। ফজর ছিলেন পরিবারের একমাত্র ছেলেসন্তান, তাদের সকল স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু। ছোটবেলা থেকে সংগ্রাম আর পরিশ্রম ছিল তার নিত্যসঙ্গী। গ্রামের কাঁচা ঘর পেরিয়ে জীবিকার টানে রাজধানীর গার্মেন্টস কারখানায় পাড়ি জমান। ভোরে কাজ, রাতে ঘুম—এর মাঝেই মায়ের মুখে হাঁসি ফোটানোর স্বপ্ন বুনতেন।
“আম্মা, আর একটু সময় দাও। ঘরটা পাকাব, তোমাদের কষ্ট আর থাকবে না”—ছুটি কাটাতে এলেই এই কথা বলত ফজর। মায়ের চোখে ছিল গর্ব, বাবার মুখে আস্থা—ছেলেটা একদিন আলোকিত করবে পরিবার, বদলে দেবে গ্রামের গরিব মানুষের ভাগ্য।
কিন্তু সে স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে।
ঢাকায় চলছিল ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিল। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে উত্তাল রাজপথে যুক্ত হয়েছিলেন ফজর মিয়াও। তিনি কোনো রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, মিছিলে স্লোগানও দিতেন না উচ্চস্বরে। তবে তাঁর বিশ্বাস ছিল—ন্যায় ও গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানোই সত্যিকারের দায়িত্ব।
বিকেলে হঠাৎ পুলিশের গুলিতে বিদ্ধ হন ফজর। ঠিক কোথায়, কার গুলি, কেউ জানে না। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সারা শরীর রক্তে ভিজে যায়। ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ একজন কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠেন—“ভাইটা গুলিবিদ্ধ!” কেউ একজন চিৎকার করে অ্যাম্বুলেন্স খোঁজেন। কিন্তু রাজপথ তখন নিস্তব্ধ। নিঃশব্দে ঝরে পড়ে গার্মেন্টস কর্মী ফজরের প্রাণ।
পরদিন সকালে তাঁর লাশ ফিরে আসে সেই শান্ত গ্রামে। যেখানে দুপুরগুলো কুয়াশা মাখা ধানখেতে হারিয়ে যেত। গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে কান্নায়।
তার মা বলেন, ‘আমার ছেলেটা তো কারও ক্ষতি করেনি। শুধু ঘরটা পাকা করতে চেয়েছিল। বই কিনা দিয়েছিল—সেই বই তো আর পড়া হলো না…’ আর বাবা শাহ আলম শুধু কাফনের কাপড় শক্ত করে ধরে বলেন, ‘তুই তো চাকরি করতে গেছিলি, শহীদ হয়ে ফিরে এলি...’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।