চাকরি নয়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবন দিলেন সুমন

গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ মো. সুমন
গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ মো. সুমন © টিডিসি সম্পাদিত

জামালপুর সদর উপজেলার শাহবাজপুর চরপাড়ার এক সাদামাটা পরিবারে জন্মেছিলো মো. সুমন। বাবা মো. বিল্লাল হোসেন ছিলেন দিনমজুর, মা মরিয়ম বেগম এক গৃহিণী। অভাব ছিলো নিত্যসঙ্গী, কিন্তু সুমনের মুখে ছিলো হাসি, চোখে ছিলো স্বপ্ন—পরিবারকে একটু ভালোভাবে বাঁচানো, আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো।

ছোটবেলা থেকেই সংসারের কষ্টের সাথে সখ্য গড়ে ওঠে সুমনের। ঠিকমতো পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি, কিন্তু জীবনের পাঠে তিনি হয়ে ওঠেন শক্ত ও সৎ একজন মানুষ। খুব কম বয়সেই কাজের খোঁজে চলে আসেন ঢাকায়। একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠতেন, কাজ করতেন সূর্য ডোবার অনেক পর পর্যন্ত। ক্লান্ত শরীর নিয়েও বাসায় ফিরে বলতেন, ‘মা, আমি ভালো আছি, তুমি চিন্তা কইরো না।’

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট—যখন পুরো দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিলো কোটা সংস্কারের দাবিতে, তখন সুমনও নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন সেই আন্দোলনের ভিড়ে। তিনি ছাত্র ছিলেন না, কিন্তু এই আন্দোলনের দাবিগুলো ছিলো তার নিজের জীবনের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি বিশ্বাস করতেন, মেধার ভিত্তিতে যদি সমাজ চলে, তাহলে একদিন তার সন্তানরা হয়তো আর এই অভাবের চক্রে আটকে থাকবে না।

আরও পড়ুন: ‘রিয়াদ বাঁচলে বিসিএস ক্যাডার হতো, সব স্বপ্ন এক নিমিষে শেষ’

৫ আগস্ট, ২০২৪। সাভারে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন সুমন। গর্জে উঠেছিল কণ্ঠ—‘কোটা নয়, মেধা চাই, বৈষম্যের বিচার চাই!’ হঠাৎই শুরু হয় পুলিশের গুলিবর্ষণ। গুলিবিদ্ধ হন সুমন। সেখানেই রক্তাক্ত শরীর নিয়ে পড়ে থাকেন কিছুক্ষণ, কেউ আর এগিয়ে যেতে পারেনি। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়।

সুমনের মৃত্যুতে পুরো গ্রাম স্তব্ধ হয়ে যায়। মা মরিয়ম বেগম ছেলের খবর পেয়ে একটাই কথা বলেন, ‘ও তো কোনো রাজনীতি করতো না… ওতো শুধু ন্যায়ের পাশে ছিলো। আমার সোনার ছেলে আর ফিরে আসবে না!’

সুমনের জন্য আজো সংসারে চুপচাপ পড়ে আছে তার জামা-কাপড়, তার চপ্পল, তার হাতের ব্যবহার করা ছোট্ট ব্যাগ। তার ছোট ভাই আজো বলে, ‘ভাইয়া বলতো, তোদের পড়াইতে পারলে আমি খুশি। এখন তো কেউ বলে না পড়তে বস।’

আরও পড়ুন: ‘স্বৈরাচার হাসিনা আমার সুখের সংসারটা তছনছ করে দিছে—আমি তার ফাঁসি চাই’

শহীদের তালিকায় মো. সুমনের নাম হয়তো কারো চোখে আসবে না প্রথমেই। তিনি ছিলেন না কোনো দলের, না ছিলেন রাজনীতির মঞ্চে। কিন্তু তিনি ছিলেন এক নীরব সংগ্রামী। যিনি জীবিকার খোঁজে শহরে এসেছিলেন, কিন্তু জীবন দিয়ে চলে গেলেন ন্যায়ের দাবিতে।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।