১০৫ বছরে পদার্পণ করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি অপ্রতুল
- ০২ জুলাই ২০২৫, ১২:২৫
আজ ১ জুলাই, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি ) ১০৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯২১ সালের এই দিনে ঢাকা ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী, ৬০ জন শিক্ষক, ৩টি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৯ হাজার ৩৩৯ জন, শিক্ষক সংখ্যা ১ হাজার ৯৮৮ জন, ৮৩টি বিভাগ ১৩টি অনুষদ রয়েছে। মাঝখানে পেরিয়ে গেলে শতকের বেশি সময়। কিন্তু এই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতি যে প্রত্যাশা তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। জুলাই অভ্যুত্থানের পর এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে প্রত্যাশা আরও বেড়েছিল। কিন্তু সব প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যায় হতাশা। ১০৫ বছরে পা রাখলেও অনেক ক্ষেত্রে এখনও পিছিয়ে রয়েছে।
এখনও কাটিয়ে ওঠেনি আবাসন সংকট
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১০৫ বছর পর এসেও এখনো শতভাগ আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমনকি হলের রুমগুলোতে নেই পর্যাপ্ত চেয়ার, টেবিলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে গণরুম প্রথা বিলুপ্ত হলে যাওয়ার পরও মেয়েদের কোনো কোনো হলগুলোতে এখনো এক রুমে থাকলে হচ্ছে ত্রিশ জনের বেশি শিক্ষার্থীদের। এদিকে আবসন সংকট নিরসনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনশন, আন্দোলন, স্বারকলিপি প্রদান করে আসছে। তবুও মিলছে না সঠিক সমাধান।
আসিফ আবরার নামে এক অনাবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, ‘হলে একটা সিট না থাকার কারণে দূর থেকে আমাদের বাসে করে আসতে হয়। অনেক সময় বিভিন্ন কারণে ঠিক সময়ে ক্লাসে উপস্থিত হতে পারি না। তাছাড়া এখন পরিবারের অবস্থাও এমন ভালো নয় যে, দীর্ঘ পাঁচ বছর বাইরে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাব। একটা বিশ্ববিদ্যালয় শতবছর পার করে দিলেও এখনো শিক্ষার্থীদের জন্য শতভাগ আবাসন নিশ্চিত করতে পারেনি, এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে?
তানিশা আক্তার নামে আরেক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের নামে মাত্র হলে সিট দেওয়া হয়েছে। নেই কোন চেয়ার, নেই কোন টেবিল। তাছাড়া এখনও আমাদের গণরুমের মতো গাদাগাদি করে থাকতে হয়।’
কবি জসিম উদ্দিন হলের শিক্ষার্থী নাইমুর রহমান রিদম বলেন, ‘১০৫ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শতভাগ আবাসিক না হওয়ার প্রধান অন্তরায় হলো ছাত্র শিক্ষক লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত ৷ আর আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের হলে থাকতে হয়৷বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি শতভাগ আবাসিক করে তাহলে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি করাতে পারবে না এবং লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বিমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়া দেশ কন্ট্রোল করা অনেক টা অসম্ভব হবে। এইজন্যই ক্ষমতাসীন দল, তাদের ছাত্র শিক্ষক সংগঠন গুলো চায় শতভাগ আবাসিক না হোক বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন।’
এদিকে প্রথম বর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতে জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠনগুলো প্রশাসনের নিকট আবাসন সমস্যা নিরসনের দাবি জানিয়েছে। সেই সাথে সিট না পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ভাতা দেওয়ার দাবিও জানান তারা।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, হলে আবাসিক সিট পাওয়ার সকল শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসকল ছাত্রীকে আসন বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে তাদের বিশেষ আপদকালীন আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ন্যায্যতা ও চাহিদার ভিত্তিতে আবেদনকারী ছাত্রীদের মধ্য থেকে নির্বাচিতদের প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা হারে এই সহায়তা প্রদান করা হবে।
আবাসন সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রশাসন বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি মেগা প্রকল্প শিগগিরই বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে ৩ হাজার ছাত্রী ও ৫ হাজার ১০০ ছাত্রের জন্য আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। চীন সরকারের অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী হল’ নির্মাণ প্রকল্প প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে, যেখানে ১ হাজার ৫০০ ছাত্রী থাকার সুযোগ পাবেন।
অনিরাপদ ক্যাম্পাস
শিক্ষার্থীদের নিরাপদ ক্যাম্পাসে দাবি বহু দিনের। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এ দাবি যে আরও জোরদার হয়ে ওঠে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করলেও এখনও নিরাপদ নয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেই চলেছে। সরকারি ছুটির দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় যেন পার্কে পরিণত হয়েছে। যার ফলে নারী শিক্ষার্থীদের শিকার হতে হয় বিভিন্ন হয়রানির।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রতিদিন সন্ধ্যার পর টিউশন থেকে আসার সময় একটা ভয় নিয়ে হলে ফিরতে হয়, কখন যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে বসে। রাস্তা পার হতে গিয়ে পড়তে হয় নানা সমস্যায়। তাছাড়া বহিরাগত কর্তৃক প্রায়ই এসব অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সহ্য করে যাচ্ছি। আমার ক্যাম্পাসে কেন আমাকে বহিরাগত কর্তৃক হয়রানির শিকার হতে হবে?
এদিকে নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের লক্ষ্যে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নিরাপত্তা জোরদারের অংশ হিসেবে এখন থেকে টিএসসি ও ভিসি চত্বর এলাকায় সার্বক্ষণিক পুলিশের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্যাম্পাসের মূল সড়কগুলোতে প্রক্টরিয়াল টিমের সঙ্গে পুলিশের টহল অব্যাহত থাকবে।
মানহীন হলের খাবার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ক্যান্টিনগুলোতে খাবারে মান নিয়ে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন। একদিকে অপুষ্টিকর খাবার পরিবেশন অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার প্রস্তুতের অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের। সেই সাথে খাবারের পরিমাণ অনুযায়ী রাখা হয় বেশি দাম। এই নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনকে অবগত করলে প্রশাসন এর সঠিক সমাধান দিতে পারছে না।
শিক্ষার্থীদের দাবি, ৫ আগস্টের পূর্বে ক্যান্টিন থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশ রাজনৈতিক দলের নেতাদের দেওয়া হতো। তখন ক্যান্টিন মালিকরা চাইলেও খাবারের মান ভালো করতে পারত না। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ক্যান্টিনের খাবারে খুব বেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।
মাস্টার দা সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থী আসিফ হোসেন বলেন,‘আমরা ভেবেছিলাম ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে খাবারের মান ভালো হবে। খুব ভালো হতে হবে তা চাই না। অন্তত যেন পুষ্টিকর কিছু খেতে দেওয়া হয়। কিন্তু সেটুকুও পাচ্ছি না। প্রায়ই আমি সহ আমার বন্ধুরা এ অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে অসুস্থ থাকি। এখন সহ্য হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনেরও কোন সদিচ্ছা দেখছি না।’
মুখস্থ নির্ভর পড়াশোনা, গবেষণার প্রতি অবহেলা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিগত ৩ থেকে ৫ বছরের প্রশ্ন পড়লেই শতভাগ কমন পড়ছে পরীক্ষায়। তাই শিক্ষার্থীরা এখন সে প্রশ্নগুলো থেকে কয়েকটি প্রশ্ন বাছাই করে পড়েই শতভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে দিচ্ছে পরীক্ষা। দিনশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্নাতকোত্তরের অধ্যয়নরত এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি আমার অনার্স জীবন পুরোটা মুখস্থ করেই পাশ করেছি। বিগত কয়েক বছরের প্রশ্ন পড়লেই শতভাগ কমন পাচ্ছি। তখন ভাবতাম তাহলে কেন কষ্ট বাইরের জ্ঞান অর্জন করতে যাবো। শিক্ষকরা যা পড়ায় সেখান থেকেই প্রশ্ন আসে। কিন্তু এখন চাকরির প্রস্তুতি নিতে এসে বুঝতে পারছি বাইরের জ্ঞান কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’
এদিকে ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে বাজেট নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা যায়। ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক হাজার ৩৫ কোটি ৫৪৫ লাখ টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। যেখানে বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের ২ দশমিক ৮ শতাংশ।
চাহিদার তুলনায় এই অপ্রতুল বাজেট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আকরাম হোসেন বলেন, যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য একটু থাকা আর পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে না সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ গবেষণা হবে এই ধারণা করাও ভুল। তাছাড়া এবারের বাজেটের দিকে লক্ষ্য করলেই দেখা যায় শিক্ষাখাত কতটুকু উপেক্ষিত।
জুলাই ঐক্যের সংগঠক এবি জুবায়ের বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৫ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে উপকরণ থাকা দরকার সেটি পূরণ করতে পারে নি। প্রথমত, মান সস্পন্ন শিক্ষা এখানে দেওয়া হয় না। এখনো পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য কষ্ট করতে হয়। যেখানে ৪ জন থাকার কথা সেখানে ৮-১০ জন থাকছে এখনো। তাছাড়া পড়াশোনার জন্য পর্যাপ্ত টেবিল নাই। তাছাড়া খাবাবের মান ভালো না। অর্থাৎ একটি প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে যে, বিষয়গুলো দরকার সেগুলো নেই।’
তিনি আরও বলেন, আমাদের গবেষণার খাতে পর্যায় বাজেট নেই। যার ফলে গবেষণা করতে পারছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যতটুকু শিক্ষার দিকে নজর দেওয়া দরকার তা না করে অতি রাজনীতির দিকে এগোচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিগত সময়ে লেজুড়বৃত্তি মনোভাব দেখিয়ে গেছে। শিক্ষক ও ছাত্রের অতি রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে বেশি মনোযোগী দেওয়ার কারণে শিক্ষা থেকে পিছিয়ে আছে। ১০৫তম জন্মবার্ষিকীকে প্রত্যাশা হলো এখানে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা বজায় থাকবে। সেই সাথে শিক্ষা খাতে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পেছন ফিরে তাকালে আমরা বলতে পারি এটি উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চার, রাজনৈতিক উত্থান-পতনের এবং জাতীয় চেতনাবোধের এক বিরল কেন্দ্র। এই শতবর্ষী প্রতিষ্ঠানটির যেমন করে কিছু বড় অর্জন আছে, তেমনি আবার আছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতার বেদনা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিনির্মাণে সামনে থেকে নেতৃত্ব দান, এক সময়ের পূর্ব বাংলার দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেয়া ও দেশ- বিদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অংশীদারি ও একাডেমিক বিনিময় কার্যক্রমের মতো গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে।
তবে এটাও সত্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ যে অবস্থায়, সেটি ১৯২১ সালের স্বপ্নদ্রষ্টাদের সর্বোচ্চ প্রত্যাশার সমান নয়। জ্ঞানচর্চার গভীরতা ও মৌলিক গবেষণায় পিছিয়ে থাকা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান রাখতে না পারা, একাডেমিক পরিবেশকে দলীয়করণ, শিক্ষকের নিয়োগে পক্ষপাত আচরণ, নিয়োগ ও ভর্তিতে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ, ছাত্ররাজনীতির সহিংসতা একাডেমিক মননকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ব্যাপক আকারে। এছাড়াও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, আর্থিক অব্যবস্থাপনা, উন্নত শিক্ষার পরিকাঠামোতে ঘাটতি ইত্যাদি।
তিনি আরো বলেন, প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার পেছনে কিছু সুস্পষ্ট কারণের মধ্যে পলিসি নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাব, শিক্ষাকে দলীয় প্রভাবমুক্ত না রাখা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ঘাটতি, গতানুগতিক পাঠক্রম, নতুন বিষয়-শাখা ও ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী কোর্স-রিসার্চ আধুনিকীকরণ না করা, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না হওয়া ও গবেষণার জন্য ফান্ডের অপ্রতুলতা।
এ দীর্ঘযাত্রায় সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনও দেশের সর্বাধিক প্রতিভাবান তরুণদের আকর্ষণ করে। যদি পরবর্তী দশকে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বাড়ানো যায়, গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা যায়, আধুনিক পাঠক্রম ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষায় রূপান্তর সম্ভব হয়, তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণ এশিয়ার গর্ব হয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ঢাবি শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন, '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, '৯০, '২৪ এর গণঅভ্যুত্থানসহ সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জহির রায়হান, মুনীর চৌধুরী, জাহানারা ইমাম, কবি সুফিয়া কামাল, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি শামসুর রাহমানের মতো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তৈরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।’
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ- জ্ঞান উৎপাদন ও চর্চা অব্যাহত রেখে উক্ত জ্ঞানের বিস্তার ঘটানো, যে জ্ঞান একটি জাতি, এমনকি পুরো মানবজাতির অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার জন্যে জরুরি হচ্ছে শিক্ষাও গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবরই অপ্রতুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের উপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, যা উদ্বেগজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৫ তম বছরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সংকটগুলো কাটিয়ে ওঠা খুবই জরুরি।
ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী ও দেশের মানুষের প্রতিটি অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণালী অবদান রয়েছে। শিল্প সাহিত্য সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ও অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। আবাসন, খাবার, ট্রান্সপোর্ট, লাইব্রেরি একাডেমিক সহ বিভিন্ন মৌলিক সংকটই এখনো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দলীয় রাজনৈতিক দখলদারিত্ব ও ভায়োলেন্স প্রধানতম একটি সমস্যা হয়ে ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগামীর দিনে আমরা চাই এ বিশ্ববিদ্যালয় একটা গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হবে। নলেজ ও পলিসি প্রোডাকশনের হাউস হিসেবে কাজ করবে। একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়া রিলেশনশিপ তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সিলেবাস তৈরি হবে। দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় লেখাপড়া শেষ হওয়ার সাথে সাথেই কর্মের জায়গা হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসিম উদ্দিন হল শাখার প্রচার সম্পাদক শেখ তারভীর বারী হামিম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার একশত পাঁচ বছর পেরোলেও বিশ্ব-সময় ও যুগের সাথে তাল মেলাতে বারংবার ব্যর্থ হচ্ছে। ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী কাঠামোর কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয় আরো ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে যুগোপযোগী সম্পূর্ণরূপে গবেষনা নির্ভর ও উৎপাদনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা কাঠামো প্রতিস্থাপিত করতে পারলে এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় এগিয়ে যাবে বলে আমি আশা রাখি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা আর্থিক সহায়তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারি নি। যার ফলে অনেকে ঝড়ে যায়। নারীদের জন্য এখনো সুরক্ষিত করতে পারি নি। এই ব্যাপারে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের আরো অনেক পথ এগোতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, ‘আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও আমরা অনেকে ছোট ছোট কাজের উদ্যোগ নিয়েছি।অনলাইনে মাধ্যমে ভর্তি ফি নেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিয়েছি। অন্যান্য সেবাগুলোও ডিজিটালাইজড করে ফেলবো খুব শ্রীঘ্রই। স্বাস্থ্য সেরার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিয়েছি। খুব শীঘ্রই ফলাফল দেখা যাবে।বিভিন্ন গবেষণায় কেন্দ্রকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করেছি। অবকাঠামো গত দিক থেকে নারী শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছি। তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি ) উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান বলেন, ‘আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। তবুও আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরো বাড়াতে হবে। বড় মাপের রাজনৈতিক কার্যালয় পরিচালনা করতে গিয়ে পড়াশোনায় যেন ক্ষতি না হয় সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য শিক্ষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’