ধর্ষিত নারীর আর্তনাদ, বিভৎস ভিডিও—এই কি আমাদের বাংলাদেশ?

 রাজু নূরুল
রাজু নূরুল © টিডিসি সম্পাদিত

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় এক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। থানায় দায়ের করা মামলার এজাহার অনুযায়ী, তিনি সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। ২৬ জুন (বৃহস্পতিবার) রাত ১০টার দিকে গ্রামেরই এক যুবক ঠিকাদার ফজর আলী তার বাড়িতে গিয়ে দরোজা ধাক্কাতে থাকে। দরোজা না খুললে সে দরোজা ভেঙে ঢুকে ওই নারীকে ধর্ষণ করে। চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে এলে ফজর আলীকে ধরে ফেলা হলেও সে পরে পালিয়ে যায়।

বলা হচ্ছে, উদ্ধার করতে যাওয়া লোকজন প্রমাণ রাখার জন্য সেই নারীর বিবস্ত্র অবস্থার ভিডিও ধারণ করেছে। সেই ভিডিও এখন ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। মুরাদনগরের ঘটনা জানতে গিয়ে ফেসবুকে সার্চ দিলে সেসব বিভৎস ভিডিও চোখের সামনে ভেসে আসে। কয়েক সেকেন্ড দেখতেই অসুস্থ বোধ হয়। এটাকে ধর্ষণ বলব, নারী নির্যাতন বলব, অপদস্ত বলব—কী বলব আসলে?

ভিডিওতে দেখা যায়, ‘উদ্ধারকারী’ লোকদের কেউ কেউ ওই নারীর গায়ে হাত তুলছে। ভয়াবহ ট্রমায় আক্রান্ত নারীটি একদিকে কাপড় খুঁজছেন, অন্যদিকে নিজেকে ভিডিও থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। এই নারী যেন পুরো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। দেশটি যেন এখন চরম বিপদগ্রস্ত হয়ে কাপড় খুঁজে ফিরছে—না জানে কী ঢাকবে, না জানে কোন হায়েনার থাবা থেকে নিজেকে রক্ষা করবে!

মুরাদনগরের ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। আগস্টের ৫ তারিখ বিকেলে যে মবের রাজত্ব শুরু হয়েছে, এটি তারই চূড়ান্ত রূপ। ড. ইউনূসের কথিত ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর বাস্তব চেহারা। সেই কারণেই ৮ আগস্ট নতুন বাংলাদেশ উদযাপনের উদ্যোগকে মনে হয়েছে প্রতীকী। এমন বাংলাদেশ আগে কখনও দেখিনি।

গত ১১ মাসে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, নির্যাতন এবং পরিকল্পিতভাবে তাদের পেছনে ঠেলে দেওয়ার যে ধারা গড়ে উঠেছে, তার ফলেই আজ মুরাদনগরের মতো ঘটনা ঘটছে। আন্দোলনের সম্মুখভাগে ছিল নারী, কিন্তু আন্দোলনের জয় হওয়ার পর রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তর থেকে নারীকে ছেঁটে ফেলা হলো। সরকার চালানো হোক কিংবা সংস্কার কমিশন গঠনের প্রশ্ন—নারী কোথাও নেই।

রাস্তায়, লঞ্চে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপরিকল্পিত নিপীড়নের মাধ্যমে নারীদের ঘরবন্দি করে ফেলা হচ্ছে। যারা পরিবার থেকে দূরে কাজ করতেন, যারা রাতের বাসে সন্তানদের দেখতে যেতেন, আজ তাঁদের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

একটা সময় মাগুরার আট বছরের শিশু আছিয়ার ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদে সরকার নড়েছিল। এখন ১০ মাসে শত শত ঘটনার মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোতে শুধু দেখা গেছে অভিযুক্তদের গলায় ফুলের মালা। ওড়না না পরায় কটুক্তি শুনতে হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, কিংবা চট্টগ্রামের লাথি মারা শিবির কর্মী—সবার ক্ষেত্রেই একই দৃশ্য: দোষীরা ফুলে-মালায় সংবর্ধিত!

নারী সংস্কার কমিশনের বিরুদ্ধেও যেভাবে বিষোদগার করা হয়েছে, ঢাকার রাস্তায় নারী অবয়বের পুতুল বানিয়ে জুতাপেটা করা হয়েছে, তাতে বোঝাই যায় এই সরকার মবের ওপর দাঁড়িয়ে। সেই মবের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেওয়ার সক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনোটাই সরকারের নেই।

সব সংস্কার কমিশনের সুপারিশ আলোচনায় এলেও, নারী সংস্কার কমিশনের একটি সুপারিশও আলোচনায় আসছে না। কারণ, তৌহিদী জনতার সঙ্গে দফারফা হয়ে গেছে। 

মুরাদনগরের ঘটনাটি একটি পরিকল্পিত সহিংসতার চূড়ান্ত রূপ। একজন অপরাধী জানে, তার বিচার হবে না। সে জানে, কেউ তাকে থামাবে না। আর তাই সে এগিয়ে যায়। যারা ভিডিও করেছে, তারা অপরাধী। কিন্তু তারাই না করলে হয়তো দেশ কিছু জানত না। পুলিশ হয়তো তিন দিন পরও মুখ খুলত না। 

আমাদের দুর্ভাগ্য, এই সরকারের কাছে বিচার চাইতে হলেও মবের মাধ্যমেই চাইতে হয়—নগ্ন ভিডিও ছড়িয়ে না দিলে কেউ নড়ে না। এই দহন, এই লজ্জা, এই রক্তাক্ত সময় কবে শেষ হবে, কে জানে!

লেখক: লেখক, অনুবাদক ও বেলজিয়ামে পিএইচডি গবেষক 
যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com