গত দুই মাসে পুশইনে ফেরত ৬৭ বাংলাদেশি, কী বলছে বিজিবি? 

সীমান্ত দিয়ে বিভিন্ন সময়ে পাঠানো বাংলাদেশিরা
সীমান্ত দিয়ে বিভিন্ন সময়ে পাঠানো বাংলাদেশিরা © ফাইল ফটো

কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা মো. আলতাফ (৩৯) দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে জীবিকার তাগিদে ভারতে গিয়ে ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। তার বৈধ কাগজপত্র না থাকলেও কাজ জুটেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তাকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।

আলতাফের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাকে সহ আরও মোট ১৩ জনকে হাত ও চোখ বেঁধে সীমান্তের দিকে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর তাকে সীমান্তের কাছাকাছি এনে হাত ও চোখের বাঁধন খুলে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠায়।

জানা গেছে, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গত দুই মাসে চার দফায় ফেনীর বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিদের ঠেলে পাঠিয়েছে। নারী, শিশু ও পুরুষসহ এসব ব্যক্তিদের জেলার বিভিন্ন উপজেলার সীমান্ত এলাকায় ঠেলে পাঠানো হয় বলে জানিয়েছে বিজিবি। 

বিজিবির তথ্যমতে, গত ২২ মে ফেনীর ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী উপজেলার সীমান্ত দিয়ে ৩৯ জন বাংলাদেশিকে ঠেলে পাঠায় বিএসএফ। এদের মধ্যে ৪ বিজিবির আওতাধীন সীমান্ত এলাকা থেকে ২৪ জন এবং ১০ বিজিবির আওতাধীন এলাকা থেকে ১৫ জনকে আটক করা হয়। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ৬ জন পুরুষ, ৫ জন নারী এবং ১৩ জন শিশু ছিল।

এর এক সপ্তাহ পর ৩০ মে ভোরে ছাগলনাইয়া উপজেলার মটুয়া সীমান্ত দিয়ে আরও ১৩ জনকে পুশ ইন করা হয়। এদের মধ্যে ৬ জন শিশু, ৩ জন নারী এবং ৪ জন পুরুষ ছিল যারা সকলে কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা। গত বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) একই উপজেলার সীমান্ত দিয়ে আরও ১১ জন বাংলাদেশিকে পুশইন করা হয়। এদের মধ্যে ১ জন পুরুষ, ৭ জন নারী ও ৩ জন শিশু রয়েছে। তাদের বাড়ি যশোর, নড়াইল ও সাতক্ষীরা জেলায়। এ ছাড়াও গত ২৬ জুন একই পরিবারের আরও ৪ জনকে ঠেলে পাঠানো হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে পুশইন হওয়া ব্যক্তিরা জানান, তারা বিভিন্ন সময়ে কাজের সন্ধানে অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছিলেন। সেখানে তারা ইটভাটায় শ্রমিক, গৃহস্থালির কাজসহ বিভিন্ন অস্থায়ী পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

পুশইন হওয়া মোমিনা বেগম বলেন, আমি কয়েক বছর আগে কাজের খোঁজে ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানে গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত ছিলাম। হঠাৎ করে আমিসহ আরো কয়েকজনকে ধরে নিয়ে আসে বিএসএফ। পরে আমাদের চোখ-মুখ বেঁধে সীমান্তে এনে ফেলে রেখে যায়।

তহিদুল আলম নামে আরেকজন বলেন, ১৯৭৯ সালে আমি আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে ভারতে যাই। সেখানেই আমাদের এক ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। দীর্ঘদিন আমরা ভারতে বসবাস করছিলাম। তবে সেখানকার পুলিশ আমাদের মুম্বাই থেকে আটক করে আগরতলা পাঠায়। পরে ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।

আমিনুল ইসলাম নামে অপর একজন বলেন, আমি অনেক বছর আগে কাজের সন্ধানে ভারতে যাই। সেখানে ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতাম। হঠাৎ করে একদিন আমাকে ধরে বিএসএফ সীমান্তে রেখে যায়।

এদিকে সম্প্রতি সীমান্তবর্তী এলাকায় পুশইনের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, একের পর এক এই ধরনের ঘটনার ফলে এলাকার নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে বিজিবি বলছে, পুশইনের মাধ্যমে পাঠানো ব্যক্তিরা সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক। তবে তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট কূটনৈতিক প্রক্রিয়া রয়েছে, যা মেনে চলা জরুরি। কিন্তু বিএসএফ সেই প্রটোকল অনুসরণ না করে রাতের অন্ধকার এবং বৈরী আবহাওয়ার সুযোগ নিয়ে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে।

ফুলগাজী উপজেলার সীমান্তবর্তী পৈথারা এলাকার বাসিন্দা নুরুল আজিম বলেন, সীমান্তে যেভাবে একের পর এক পুশইনের ঘটনা ঘটছে তা আমাদের এলাকার নিরাপত্তার জন্যও উদ্বেগের বিষয়। আমাদের বাড়িঘর সীমান্তের একেবারে কাছেই। ফলে এসব ঘটনা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। 

তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এবং ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধান নিশ্চিত করা।

ছাগলনাইয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার আরেক বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন বলেন, সীমান্ত দিয়ে বিএসএফের পুশইন করার ঘটনা আমাদের এলাকার জন্য চিন্তার কারণ। আমরা চাই, সরকার এই ব্যাপারটা গুরুত্ব সহকারে দেখুক এবং দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করুক, যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে।

বিজিবির ফেনী ব্যাটালিয়ন (৪ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বাংলাদেশি নাগরিকদের এভাবে পুশইন করা শিষ্টাচারবহির্ভূত। যদিও তারা আমাদের দেশের নাগরিক, তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট কূটনৈতিক প্রক্রিয়া রয়েছে যা মেনে চলা উচিত। 

সীমান্তে কড়া নজরদারি থাকার পরও কীভাবে পুশইনের ঘটনা ঘটে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুশইন হওয়া ব্যক্তিরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তারা যখন জিরো লাইন পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ফেলে, তখন আমাদের জিরো লাইন পেরিয়ে তাদের ফেরত পাঠানোর সুযোগ নেই। 

তিনি আরও বলেন, আমরা চাইলে তাদের নোম্যানসল্যান্ডে দিনের পর দিন আটকে রাখতে পারি, কিন্তু সেটা হবে আরও অমানবিক। কারণ তারা আমাদের দেশেরই মানুষ। তাই মানবিক দিক বিবেচনা করে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা তাদের পরিচয় যাচাই করে নিজ নিজ ঠিকানায় পাঠিয়ে দিই। তবে তারা বাংলাদেশের নাগরিক না হলে তাদেরকে পুশব্যাক করে দেওয়া যেত। 

পুশইন হওয়া ৬৭ জন সম্পর্কে তিনি বলেন, সবারই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে এবং সবার ঠিকানা পাওয়া গেছে। আমরা ঠিকানানুযায়ী স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদের নিজ নিজ জেলায় পাঠিয়েছি। পাশাপাশি প্রতিটি ঘটনার পরপরই আমরা বিএসফকে প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছি। তবে এসব ঘটনার প্রতিরোধে সীমান্তে বিজিবি কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখবে বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি সীমান্ত এলাকা দিয়ে যেসব ব্যক্তি পুশইনের শিকার হয়েছেন তারা সকলে বাংলাদেশের নাগরিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাই এতে সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের উদ্বিগ্ন বা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। অন্য দেশের নাগরিক হলে তা অবশ্যই চিন্তার বিষয় হতো। তিনি আরও জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসন সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।