জুলাইয়ের জাগরণ: নেতৃত্বের বদল নয়, কাঠামোর পরিবর্তন চাই
- ১৩ জুন ২০২৫, ০৮:০৬
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে গণজাগরণ দেখা যায়, ইতিহাস একে কী নামে ডাকবে তা সময়ই বলে দেবে। কেউ এটিকে ‘জুলাই বিপ্লব’ বলতে চাইবে, কেউবা বলবে ‘ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বাতিঘর’। আবার কারও দৃষ্টিতে হয়তো এটি যোগ হবে আরেকটি ‘ব্যর্থ আন্দোলনের তালিকায়’ যোগ। কিন্তু এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণ বিশেষত তরুণ প্রজন্ম আর সেই পুরনো, দুর্নীতিগ্রস্ত, অসম ব্যবস্থাপনা মানতে রাজি নয়।
এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল—একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কেবল কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান? নাকি তার আগে প্রয়োজন একটি ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলা? বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা একজন প্রধানমন্ত্রীকে প্রায় একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়, ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও সে নেতা যেনতেনভাবে ক্ষমতা ব্যবহার করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে পারেন। এ বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে—সংবিধান ও রাজনৈতিক কাঠামো সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের অর্থ কী?
আজ আমরা এমন একটি বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, যেখানে আইন ও সুযোগ সব নাগরিকের জন্য সমান নয়। একজন সাধারণ নাগরিক একবার মামলায় জেল খাটলেই তার ভোটাধিকার হারায়, সরকারি চাকরির স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। অথচ রাজনীতিকরা জেলে বসেই নির্বাচনে জিতে সংসদে প্রবেশ করেন। একজন তরুণ, ব্যাংকের ১০ হাজার টাকার চাকরির জন্য বহু পরীক্ষা দিয়ে, ধাপে ধাপে যোগ্যতা প্রমাণ করে, চাকরির পরে অবসরে যেতে বাধ্য হন ৫৯ বা ৬০ বছর বয়সে। অথচ একজন অশিক্ষিত, অক্ষম রাজনীতিবিদ—যিনি হাঁটতে পারেন না, স্পষ্ট কথা বলতে পারেন না—তিনিই হয়ে থাকেন দেশের অর্থমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
এমনকি একজন অশিক্ষিত সংসদ সদস্য হয়ে যান স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি। ভাবা যায়! যিনি হয়ত এসএসসি পাশও করতে পারেননি, তিনি একটি স্কুল বা কলেজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন। বাস্তবে তিনি মনোযোগ দেন শুধু নিয়োগ-বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য ও টেন্ডার দখলে—ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও দুর্নীতি ও অযোগ্যতা বিস্তার করে।
এই বাস্তবতা কি কেবল দুঃখজনক? না কি এটি একটি চিহ্ন—যেখানে একটি জাতি তার সবচেয়ে যোগ্য, শিক্ষিত ও মেধাবী অংশকে উপেক্ষা করে কেবল সুবিধাবাদীদের রাজনীতিতে স্থান দেয়? তরুণরা যখন দেশের সর্বত্র প্রতিযোগিতা ও পরীক্ষার মুখোমুখি হয়, তখন রাজনীতি যেন একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে কোনো মেধা, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা নৈতিক মানদণ্ডের প্রয়োজন নেই। অথচ রাজনীতি হলো এমন একটি ক্ষেত্র, যা জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার সবচেয়ে বড় চালক।
এই সমস্যার সমাধান কী? প্রথমত, আমাদের সংবিধানে সাংসদ হওয়ার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা উচিত—কমপক্ষে স্নাতক পাস। সংসদ সদস্যগণ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করেন, বাজেট পাশ করেন, আইন প্রণয়ন করেন—তাদের মধ্যে মৌলিক বিশ্লেষণী ও নৈতিক দক্ষতা থাকা জরুরি। আমরা আর সংসদে দেখতে চাই না টেন্ডারবাজ, দখলদার কিংবা রাজনৈতিক মাফিয়াদের।
দ্বিতীয়ত, তরুণ নেতৃত্বকে এগিয়ে আনার জন্য সাংবিধানিক কোটা নির্ধারণ করতে হবে—যেমন অন্তত ৬০% সাংসদ হতে হবে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী তরুণ। এর মাধ্যমে শিক্ষিত, উদ্যমী এবং প্রযুক্তিনির্ভর একটি প্রজন্মকে রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, যারা দেশের বাস্তব সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান দিতে পারে। বর্তমানে রাজনীতিতে প্রবেশ মানেই দলীয় অনুগত্য, আর্থিক পেছনে শক্তি, কিংবা পরিবারতন্ত্রের আশীর্বাদ। এই সংস্কৃতি না বদলালে রাজনীতি কখনোই জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী ক্ষেত্র হয়ে উঠবে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—রাজনীতির জন্যও অবসরের বয়স নির্ধারণ করতে হবে। যেমন ৬৫ বছর পার হলে কেউ আর সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। কারণ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা কমে আসে—যা সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলে। তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে, প্রবীণদের জন্য স্বাভাবিক অবসর নিশ্চিত করাও জরুরি।
তৃতীয়ত, এই কাঠামোগত অসাম্য ও রাজনীতির পচনশীল বাস্তবতা কেবল ব্যক্তি বা দলের ব্যর্থতা নয়, এটি একটি পদ্ধতিগত সংকট। বাংলাদেশে শিক্ষিত, নীতিনিষ্ঠ, দক্ষ তরুণদের রাজনীতিতে আসা প্রায় অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। কারণ বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল চালিকাশক্তি হলো পেশিশক্তি, পুঁজি ও পারিবারিক পরিচয়। এই পরিস্থিতিতে প্রকৃত জনগণের প্রতিনিধি সংসদে পৌঁছাতে পারেন না। তার বদলে সেখানে যায় ব্যবসায়ী-ডন-দখলদার শ্রেণি—যাদের মূল লক্ষ্য দেশ নয়, নিজের স্বার্থ।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার অভাব। একটি স্কুলের শিক্ষক ভুল করলে তার চাকরি যায়, চিকিৎসক ভুল করলে লাইসেন্স বাতিল হয়—কিন্তু একজন সংসদ সদস্য পাঁচ বছর জনগণের টাকায় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেও যদি তার এলাকায় কোনো উন্নয়ন না করেন, তার কোনো জবাবদিহি নেই। কেউ প্রশ্ন তোলে না, তিনি পাঁচ বছরে কী করলেন। এমনকি অনেকে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগই রাখেন না।
এই ব্যবস্থায় রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতা ও প্রাপ্তির উৎস, ত্যাগ ও সেবার নয়। তাই প্রয়োজন এমন একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো যেখানে যোগ্যতা, জবাবদিহি ও নৈতিকতা হবে নেতৃত্বের ভিত্তি। না হলে, আমরা শুধু সরকার বদলাব, ব্যবস্থা নয়—আর সত্যিকারের পরিবর্তন কখনো আসবে না।
সর্বশেষে, এ কথাটি বুঝতে হবে—একটি জাতির উন্নয়ন নির্ভর করে তার নেতৃত্বের গুণগত মানের ওপর। যদি নেতৃত্বের আসন অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ, অশিক্ষিতদের হাতে থাকে, তাহলে সেই জাতি কখনোই আত্মমর্যাদাশীল, স্বনির্ভর বা মানবিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে না। নির্বাচন নয়, কাঠামোগত সংস্কারই এখন সময়ের দাবি। এখন সময়—সচেতন হওয়ার, প্রশ্ন করার এবং দাবি জানানোর। যদি আমরা চাই সত্যিকার পরিবর্তন, তাহলে আমাদেরকে শুধু ভোট নয়, ভাবনার বিপ্লব ঘটাতে হবে। আর সেই বিপ্লব শুরু হোক আজই, আমাদের ভেতর থেকে।
লেখক
ড. মোর্ত্তুজা আহমেদ
সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।