বাকৃবি শিক্ষার্থীদের ভাবনায় ঈদ আনন্দ

ঈদুল আজহা নিয়ে বাকৃবির শিক্ষার্থীদের ভাবনা
ঈদুল আজহা নিয়ে বাকৃবির শিক্ষার্থীদের ভাবনা © টিডিসি

সারা বছর ব্যস্ত থাকা একঝাঁক তরুণ-তরুণী ঈদের ছুটিতে ঘরে ফেরে। কারও হৃদয়ে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরার আনন্দ, কারও চোখে শূন্যতার দীর্ঘশ্বাস। কেউ খুঁজে ফেরে শৈশবের ঈদ, কেউ আবার অপেক্ষায় থাকে, কারও মুখে একটুখানি হাসি ফোটাতে।

ঈদ শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাঙালি মুসলমানের আবেগ, সংস্কৃতি ও পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক। ঈদুল আজহা সেই উৎসব, যেখানে কেবল আনন্দই নয়- থাকে আত্মত্যাগ, আত্মনিবেদন ও সামাজিক সমতার বার্তা। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর নিঃস্বার্থ আনুগত্যের কাহিনি আর আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে প্রিয়তমকে কোরবানির প্রস্তুতির গল্প আমাদের শিখিয়ে দেয়, প্রকৃত ঈমানদার হতে হলে চাই ত্যাগের মানসিকতা। কোরবানির পশুর রক্তে নয়, আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তাকওয়াই। এই উপলব্ধি প্রতিটি ঈদুল আজহায় নবায়ন হয়।

কিন্তু প্রশ্ন থাকে-আজকের প্রজন্ম, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, যারা দেশের ভবিষ্যৎ চালকের আসনে বসবে, তারা কীভাবে দেখছে ঈদুল আজহাকে? তারা কি শুধু ঈদের আনন্দে মত্ত, নাকি এই উৎসবের গভীর দিকগুলো নিয়েও ভাবে? বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীদের চিন্তা-ভাবনায় ঈদুল আজহার মূল দর্শন কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে, চলুন শুনে নিই তাদেরই ভাষায়-

ঈদুল আজহা আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয়

ঈদ মানেই আনন্দ। ধর্মীয় দিক বিবেচনায় আমরা আমাদের এই আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিই। ঈদুল আজহা আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয়। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার মনে হয়, এই উৎসব আনন্দ, ধৈর্য, ত্যাগ এবং স্রষ্টার সন্তুষ্টিসহ নানা মানবীয় গুণাবলি বিকাশের একটি মাধ্যম। ক্লাস ও পরীক্ষার সব চাপ থেকে নিজেকে কিছুদিনের জন্য মুক্ত করে ঈদের দিনগুলো পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কাটানো, স্কুল-কলেজের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়া—সব মিলিয়ে চমৎকার একটি সময় কাটবে বলে আশা করছি। বর্তমান বাস্তবতায় সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় রেখে আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যই হোক আমাদের প্রতিটি উৎসব উদযাপনের মূল বার্তা।

-সাগর আল হাসান , কৃষি অনুষদ

আত্মত্যাগই হলো ঈমানের সেরা প্রকাশ

ঈদুল আজহা আমাদের শেখায় প্রকৃত সুখ আসে ত্যাগের মাধ্যমে। মহান আল্লাহ আমাদের এই বিশেষ দিনটি দিয়েছেন হালাল পথে আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করার জন্য। তবে কোরবানির মাধ্যমে তিনি যেন আমাদের শিখিয়ে দেন, আত্মত্যাগই হলো ঈমানের সেরা প্রকাশ। ঈদ একজন মুসলিমের মৌলিক অধিকার হলেও বিশ্বজুড়ে অনেকেই সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত বিশেষত ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষরা। মানুষ হিসেবে এটি আমাদের লজ্জিত করে। এবারের ঈদে তাই আমার সবচেয়ে বড় প্রার্থনা বিশ্ব বিবেক যেন তাদের পাশে দাঁড়ায়।

এই ঈদ আমার জীবনে ব্যতিক্রম। আগের বছর বাবা ছিলেন, তিনিই সব আয়োজন করতেন। এবার তিনি নেই। তার অভাব ঈদের আনন্দকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। তবুও ঈদ আসবে, স্মৃতির গভীরে রেখে যাবে আরও কিছু অনুপস্থিতির অনুভব। একটাই কথা কোরবানির মাংস নয়, আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য কেবল তাকওয়া। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

-মো: সেলিম রেজা সত্য, ভেটেরিনারি অনুষদ

ত্যাগ, ভালোবাসা ও পরিবারকে ঘিরে উদযাপনের এক অপূর্ব উপলক্ষ

ঈদুল আজহা আমাদের জন্য শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি ত্যাগ, ভালোবাসা ও পরিবারকে ঘিরে উদযাপনের এক অপূর্ব উপলক্ষ। পরিবারের সবার সঙ্গে সকালবেলা ঈদের নামাজ আদায় করে কুরবানির প্রস্তুতি নেওয়াতেই আছে এক ভিন্ন আনন্দ। গরু বা খাসি কুরবানি দেওয়ার পর সবাই মিলে মাংস ভাগ করা, রান্না করা এবং আত্মীয়-স্বজনের বাসায় তা পৌঁছে দেওয়া—সবই ঈদের আনন্দের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ বছরেও ঠিক তেমনটাই করার পরিকল্পনা রয়েছে। ঈদের পরদিন হয়তো আশেপাশে কোথাও ঘুরতে যাওয়ারও ইচ্ছা আছে, যেন প্রকৃতির মাঝে ঈদের ছুটি আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ঈদ মানেই একসঙ্গে থাকার আনন্দ, প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফোটানোর আরেক নাম।

-নূর আয়েশা চৌধুরী, মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ

শুধু পশু জবাই নয়, বরং আত্মসংযম ও পরম করুণাময়ের প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ

ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। যার মর্মার্থই হলো ত্যাগের উৎসব। নিজের ও পরিবারের স্বপ্ন পূরণের আশায় প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থীকে ছাড়তে হয় প্রিয়জন, পরিচিত পরিবেশ, আরামদায়ক জীবন। অচেনা মানুষের ভিড়ে, নতুন জীবনের খোঁজে শুরু হয় এক ভিন্ন পথচলা। তবু ঈদ মানেই ফিরে যাওয়া শৈশবের সেই সোনালি মুহূর্তগুলোতে। চাঁদরাতে ছোট বোনদের হাতে মেহেদি দেওয়া, মিষ্টান্ন রান্নায় মাকে সাহায্য করা, ঈদের সকালে ঘুম ভেঙে উঠেই নামাজের প্রস্তুতি, ঈদের পর কোরবানির দৃশ্য দেখা, তিনভাগে ভাগ করে মাংস বিতরণ—এইসব ছোট ছোট কাজই মিলেমিশে ঈদকে অর্থবহ করে তোলে। ছোটবেলায় কুরবানির আসল তাৎপর্য হয়তো অনুধাবন করতে পারিনি। কিন্তু আজ বুঝি—এটি শুধু পশু জবাই নয়, বরং আত্মসংযম, নিঃস্বার্থতা ও পরম করুণাময়ের প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ। পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র—এই দীক্ষা যদি সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে, তবে গড়ে উঠবে এক ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাময় সমাজ।
এই ত্যাগের উৎসবে আমার একটাই প্রার্থনা—আল্লাহ যেন আমাকে অহংকারমুক্ত, বিনয়ী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। জীবনে কখনো এতটা বড় হতে চাই না, যাতে আমার মাঝে অহংকার জন্ম নেয়।’

-মাহফুজা খাতুন, কৃষি অনুষদ

শুধু পশু জবাই নয়, বরং আত্মসংযম, নিঃস্বার্থতা ও পরম করুণাময়ের প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ

ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই খুশির জোয়ার। মুসলিম উম্মাহর অন্যতম বৃহৎ উৎসব ঈদুল আজহা, যা ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে এই উৎসব পালিত হয়। দুই ঈদের মধ্যে আমি ঈদুল আজহাকে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি। ঈদের সকালে নতুন পোশাক পরে ঈদগাহ বা মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায়, নামাজ শেষে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ—এই সবকিছুতেই থাকে অপূর্ব এক আনন্দ। এরপর শুরু হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি। কোরবানি শেষে বিকেলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে যাওয়া হয়, যা ভার্সিটির ব্যস্ত জীবনে খুব একটা হয়ে ওঠে না। ঈদুল আজহা সেই হারিয়ে যাওয়া সুযোগ ফিরিয়ে আনে। কোরবানির মাংস হাতে আত্মীয় বাড়িতে যাওয়া, তাদের কুশলাদি জানা, নানা রকম ঘরোয়া মজাদার খাবার খাওয়া—সবকিছুই যেন স্মরণ করিয়ে দেয় ফেলে আসা শৈশবের দিনগুলোকে।

-নওফেল হাসান রাফি, ইন্টারডিসিপ্লিনারী ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটির

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময়কার ঈদের স্মৃতি সবচেয়ে গভীর

ঈদ মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলেও এ উৎসবের আনন্দ যেনো সব ধর্ম ও পেশার মানুষের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদের উপভোগের ধরন অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। আগে নতুন কাপড় না লাগলে ঈদ অসম্পূর্ণ মনে হত, এখন তা এমন নয়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময়কার ঈদের স্মৃতি সবচেয়ে গভীর। সবাই বলত, এই ঈদ তুমি কঠোর পরিশ্রম করো, ভবিষ্যতে আরও ভালো ঈদ উপভোগ করবে। সেই চাপ আর হতাশার মাঝেও পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলাম। রোজার ঈদে তারাবীহের পর সেহেরী পর্যন্ত পড়া সেই সময়গুলো আজীবন স্মরণীয় থাকবে। এখন আমি হয়তো আমার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছি, আমার সেই শ্রম গুলো কাজে লেগেছে কিন্তু নিজের শৈশব কে হারিয়েছি , নিজের সেই সোনালী মুহূর্ত গুলোকে পিছনে ফেলে সামনে চলে এসেছি জা হয়তো শুধু আমার নয় প্রত্যেকের জীবনের আক্ষেপ ।

-মো. মেহেরাজ হোসেন ইমন, কৃষি অনুষদ