ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৫ বছরে দুই হাজার শিক্ষক নিয়োগ-পদোন্নতি, নিয়মের লঙ্ঘনকারীদের খুঁজছে প্রশাসন
সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে চাকরিচ্যুত
- মোফাচ্ছের এইচ ইমরান
- ০২ জুন ২০২৫, ১০:৩৫
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) দুই হাজারের অধিক শিক্ষকের নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় পরিচয়ে শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পর অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের নেতৃত্বে নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নিয়েছে। নতুন প্রশাসন আওয়ামী শাসনামলে নিয়োগ ও পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকদের খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বর্তমানে এ কমিটি নিবিড়ভাবে তদন্ত করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়মের লঙ্ঘন করে নিয়োগ ও পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকদের বিষয়ে খোঁজ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা অনুষদ ও ইনস্টিটিউটে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবেও যে কেউ অভিযোগ জমা দিতে পারবেন। এখন সেগুলো খুঁজে বের করতে নিবিড়ভাবে তদন্তের পাশাপাশি দফায় দফায় বৈঠক করে পর্যালোচনা করছেন কমিটির সংশ্লিষ্টরা। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে নিয়মের লঙ্ঘন প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুত হতে পারে বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, গত ১৩ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে শিক্ষক নিয়োগ-সংক্রান্ত কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি হয়ে থাকলে তা তদন্ত করে দেখার উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বর্তমান সিন্ডিকেট সদস্য ড. তাজমেরী এস এ ইসলামকে আহ্বায়ক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদসহ পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন, লোকপ্রশাসন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সিন্ডিকেট সদস্য ড. আকা ফিরোজ আহমদ, আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ইকরামুল হক এবং বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার মুন্সী শামস উদ্দীন আহমেদ।
কমিটি ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ-পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকদের অনিয়ম খতিয়ে দেখবে। এর আগে জানুয়ারি মাসে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। সেখানেও প্রায় অভিন্ন টপিক ‘বিগত ১৫ বছর ধরে বৈষম্যের শিকার শিক্ষক এবং শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ’ করার জন্য এ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট-আইবিএর অধ্যাপক ড. মো. মহিউদ্দিন। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এম এ কাউসার।
এছাড়াও গত মে মাসে সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খানকে আহ্বায়ক করে তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিও গত ১৫ বছর ধরে চলা শিক্ষার্থী নিপীড়নের বিষয়টা নিয়ে অনুসন্ধান চালাবে। এ জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান অথবা কমিটির কাছে বক্তব্য প্রদানে ইচ্ছুক ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আহ্বান জানানো হয়।
সূত্র বলছে, এই কমিটিগুলো অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি করে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল নিয়েও কথা উঠেছে অভ্যন্তরীণ আলোচনায়। এমনকি বেশ শক্ত অবস্থান থেকেই এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ড. তাজমেরী এস এ ইসলামকে ও ড. মামুন আহমেদ নেতৃত্বাধীন কমিটিটি মূলত শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া, বিজ্ঞাপনে থাকা আসন সংখ্যার অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ পাওয়া, বিজ্ঞাপনের বিভিন্ন শর্ত পূরণ না করে শিক্ষক নিয়োগ পাওয়া, মেধা তালিকায় পিছিয়ে থাকা ব্যক্তিদের শিক্ষক বানানোসহ নানা বিষয় বিশ্লেষণ করবে তারা।
এ জন্য বিভিন্ন অনুষদ ও ইনস্টিটিউটকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে থেকে আসা অভিযোগগুলোকে বিশেষ বিবেচনায় নেবে কমিটি।
২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এরপর টানা ২০১৭ পর্যন্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে এই উপাচার্যের সময়েই সবচেয়ে বেশি অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি এবং সার্কুলারের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ এবং পদোন্নতি দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে প্রায় ১ হাজার ৩৪৬ জনকে শিক্ষক হিসেব নিয়োগ বা পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর পরে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৭ বছরের আরো ৮৫০ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ বা পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সর্বমোট ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে সর্বমোট ২ হাজার ১৯৬ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ বা পদোন্নতি দেওয়া হয়।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চার স্তরের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরমধ্যে রয়েছে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক। প্রভাষক পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। বাকি তিন পদে পদোন্নতির পাশাপাশি সরাসরি নিয়োগও দেওয়া হয়ে থাকে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তিন পদে পদোন্নতি বেশি দেওয়া হয়।
তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সিন্ডিকেট সদস্য ড. তাজমেরী এস এ ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এ নিয়ে আমরা মিটিং করেছি। ঈদের পরে আরেকটা মিটিং করব। প্রত্যেকটা অনুষদ ও ইনস্টিটিউটে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগ জানাতে চায় তাহলেও জানাতে পারে।
কমিটি কি কি বিষয় অনুসন্ধান করবে, এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে বিজ্ঞাপনের শর্ত পূরণ করা হয়নি কিন্তু তাকে শিক্ষক হিসেবে নেওয়া হয়েছে। চারটা ফার্স্ট ক্লাস থাকার কথা, দেখা যায় এখানে একটা ফার্স্টক্লাস কম আছে। মেধাক্রম প্রথম থেকে নেয়া হয়নি। শেষ দিক থেকে পছন্দের কাউকে নিয়েছে। এছাড়া বিজ্ঞাপনের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ কি শাস্তি হতে পারে এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, একটা সাজেশন নিয়ে আমাদের আলোচন হয়েছে। কিন্তু ঐক্যমত হয়নি। তবে আলোচনা বিষয়টা এখন বলা যাবে না।
কমিটির এক সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন নাম-পরিচয় প্রকাশ না করা শর্তে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কমিটি তদন্ত করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আইনজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। এরপর কমিটি প্রতিবেদন দিলে তারা সিন্ডিকেট সভায় উঠবে। এতে নিয়োগে নিয়মের লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে সংশ্লিষ্টদের নিয়োগ বাতিল।