কয়েক টাকা বিনিয়োগ করে কোটিপতি, বেড়েছে ‘ফ্যান্টাসি গেমের’ জনপ্রিয়তা

বেড়েছে ‘ফ্যান্টাসি গেমের’ জনপ্রিয়তা
বেড়েছে ‘ফ্যান্টাসি গেমের’ জনপ্রিয়তা © সংগৃহীত

গত ১৭ মে থেকে আবার শুরু হওয়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) নিয়ে খুশিতে ফেটে পড়েছেন অনেকেই। তবে দিল্লির ধর্মেন্দ্র গৌতমের এই উচ্ছ্বাস শুধুই ক্রিকেটপ্রেম থেকে নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে উপার্জনের একটি সম্ভাবনাও। গাড়ি পার্কিংয়ের দায়িত্বে থাকা গৌতম জানান, আইপিএল-এর সময়টাই তার কাছে সুযোগ হয়ে ওঠে ‘ফ্যান্টাসি গেমিং অ্যাপ’-এর মাধ্যমে কিছু টাকা রোজগার করার।

গৌতম বলেন, ‘খেলার রোমাঞ্চ আর জেতার সম্ভাবনাই আমাকে টানে।’

ফ্যান্টাসি অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা বাস্তব খেলোয়াড়দের নিয়ে নিজেদের দল তৈরি করেন। খেলোয়াড়রা মাঠে যেভাবে পারফর্ম করেন, সেই অনুযায়ী অ্যাপে পয়েন্ট মেলে। এসব পয়েন্ট ব্যবহার করে লিডারবোর্ডে এগিয়ে গিয়ে নগদ পুরস্কার জেতার সুযোগ থাকে।

শুরুতে মাত্র এক টাকা ‘এন্ট্রি ফি’ দিয়ে লক্ষাধিক টাকা জেতার স্বপ্ন দেখতে পারেন কেউ কেউ। ফলে গৌতমের মতো অনেকের কাছেই এটি হয়ে উঠেছে জীবিকার এক বিকল্প মাধ্যম, যেখানে খেলা দেখা আর টাকাও উপার্জনের সুযোগ—দুয়োটাই একসাথে।

ফ্যান্টাসি ক্রিকেটের বাজার ভারতে
ভারতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাই ‘ফ্যান্টাসি গেমিং অ্যাপ’-এর পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই সস্তা ডেটা প্যাকের প্রতিযোগিতা এই অ্যাপগুলোর বিস্তারকে তরান্বিত করেছে। এখন মোবাইল থেকেই লাইভ খেলা দেখা এবং ফ্যান্টাসি অ্যাপে খেলা—দুটোই সাধারণ মানুষের নাগালে।

কেপিএমজি-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ভারতে ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৬.৮ কোটির থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬ কোটিতে। আর ফ্যান্টাসি স্পোর্টস অপারেটরের সংখ্যা ১০ থেকে বেড়ে ৭০-এ পৌঁছে।

২০১৯ সালে ‘ড্রিম ১১’ ভারতের প্রথম ইউনিকর্ন ফ্যান্টাসি গেমিং প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হয়, যার সম্পদের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। এরপর ‘মোবাইল প্রিমিয়ার লিগ’ (২০২১) এবং ‘গেমস ২৪x৭’ (২০২২) একই পর্যায়ে উঠে আসে।

‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ফ্যান্টাসি স্পোর্টস’ (FIFS)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ২২.৫ কোটির বেশি মানুষ ফ্যান্টাসি স্পোর্টস অ্যাপ ব্যবহার করেন এবং এর ৮৫ শতাংশই কেবলমাত্র ক্রিকেটের জন্যই যুক্ত।

স্বপ্নের টাকা, বাস্তবের ঝুঁকি
দ্রুত অর্থ উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা এই গেমিং অ্যাপগুলোর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে। দিল্লির ক্রীড়া সাংবাদিক সিদ্ধান্ত আনে বলেন, “এই অ্যাপগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন মনে হয় আপনি নিশ্চয়ই জিতবেন।”

এই আশায় অনেকেই রাতারাতি বদলে যেতে চান। যেমন মির্জাপুরের দয়ারাম, যিনি একটি ম্যাচে তিন কোটি টাকা জিতে খবরের শিরোনাম হন। তবে তিনি নিজেই বলেন, “আমি খেলা ছেড়ে দেব, কারণ এখানে হারার সম্ভাবনাও প্রবল।”

তার উল্টো চিত্র দেখা যায় দিল্লির মহম্মদ রকিবের ক্ষেত্রে। প্রতিটি ম্যাচে দল গড়েও তিনি আজ পর্যন্ত কিছুই জেতেননি। তবুও তিনি খেলে চলেছেন, “এই গেমে এক ধরনের উত্তেজনা আছে। আজ হারলেও মনে হয় কাল জিতব।”

কেপিএমজি-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, যাদের বার্ষিক আয় তিন লক্ষ টাকার কম, তাদের ৪০ শতাংশই সপ্তাহে পাঁচবারের বেশি ফ্যান্টাসি গেম খেলে থাকেন। তাদের অনেকেই মূলত অর্থ জয়ের আকাঙ্ক্ষায় যুক্ত হন।

নিয়ন্ত্রণের অভাব ও মানসিক স্বাস্থ্য
তবে এই আকর্ষণের বিপরীত দিকও ভয়াবহ। মার্চ ২০২৫-এ বিহারে এক ব্যক্তি দুই কোটি টাকা হারিয়ে আত্মহত্যা করেন এবং দায় চাপান ফ্যান্টাসি ক্রিকেটের উপর।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মনোজ কুমার শর্মার মতে, কোভিডের পর এই আসক্তি আরও বেড়েছে। “একটা বিভ্রম তৈরি হয়, যেন সবকিছুই নিজের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু জেতা না-হওয়ায় হতাশা তৈরি হয়।”

এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালে তামিলনাড়ু ও মধ্যপ্রদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইন গেমিং নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে এখনো পর্যন্ত কোন পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রক কাঠামো কার্যকর হয়নি।

আইন ও বিতর্ক
ফ্যান্টাসি গেমিং আসলে দক্ষতাভিত্তিক নাকি ভাগ্যনির্ভর—এই প্রশ্ন আইনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। সুপ্রিম কোর্ট এখন পর্যন্ত দক্ষতার উপর ভিত্তি করে একে বৈধতা দিয়েছে, ফলে রাজ্য সরকারগুলোর নিষেধাজ্ঞা কার্যত কার্যকর করা যাচ্ছে না।

২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই গেমে জেতা পুরস্কারের উপর ১৮ শতাংশ জিএসটি আরোপ করে, যা অ্যালকোহল ও তামাকজাত পণ্যের সমমানের। তবে এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে।

যদিও বিতর্ক থামছে না, তবু ফ্যান্টাসি গেমিং অ্যাপের ব্যবহার বাড়ছেই। অনেকের কাছে এটি এখন দৈনন্দিন জীবনের অংশ, কারও কাছে তা আনন্দ, কারও কাছে উপার্জনের একমাত্র পথ, আবার কারও জন্য বিপদের শুরু।

ধর্মেন্দ্র গৌতমের ভাষায়, ‘আমি খেলি কারণ আশেপাশে সবাই খেলে। মনে হয়, একদিন আমিও জিতব। তাই থেমে যাওয়া যায় না।’