বেশি সংস্কার, কম সংস্কারের নিক্তিটা কী?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি © টিডিসি সম্পাদিত

“বেশি রিফর্ম হলে জুন নির্বাচন, কম রিফর্ম হলে ডিসেম্বরে নির্বাচন”—এই যুক্তিটা প্রফেসর ইউনুসকে যে শেখাইছে, তার সাথে কথা বলতে চাই। গত তিন মাসে সংস্কার প্রস্তাব গুলো নিয়ে আমি, অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান, প্রফেসর আসিফ শাহান, রাষ্ট্রচিন্তার হাসিব ভাই ও ভয়েস ফর রিফর্মের ফাহিম মাশরুর ইনটেনসিভলি কাজ করেছি। আমাদের সাথে নাগরিক কোয়ালিশান ও তার বাহিরের আরও অনেকে ছিলেন। তিন মাস ধরে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রস্তাবের বিভিন্ন ক্লজ নিয়ে দীর্ঘ অ্যানালাইসিস করেছি, আন্তর্জাতিক রেফারেন্স ঘেঁটেছি। প্রফেসর রিদওয়ানসহ বিভিন্ন প্রফেশনালের সাথে আলাপ করেছি। জুম মিটিং করেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিএনপি, জামাত, এনসিপির সাথে বসেছি বেশ কয়েকবার।

আমরা বিভিন্ন কমিশনের সাথে বসেছি, তারা সবাই আমাদের কাজের গভীরতা দেখে আমাদেরকে অ্যাপ্রিসিয়েট করেছেন এবং আমি কনফিডেন্টলি বলতে পারি, ঐক্যমত কমিশনের তাদের কনসেন্সাস পজিশনে আমাদের টেকনিকাল আর্গুমেন্ট থেকে অনেকগুলো প্রস্তাব নিয়েছেন—কারণ আমরা সলিড অ্যাকাডেমিক ও টেকনিকাল জায়গা থেকে তাদের পজিশনটাকে প্রশ্ন করেছি।এই অভিজ্ঞতা থেকে, আমার কাছে প্রফেসর ইউনুসের “বেশি রিফর্ম হলে জুন নির্বাচন, কম রিফর্ম হলে ডিসেম্বরে নির্বাচন”—এইটা কমপ্লিটলি বিভ্রান্তিকর যুক্তি মনে হয়েছে।এই বিভ্রান্তির ভিত্তিতে যদি রাজনৈতিক দলগুলো দোষারোপ করে যে সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার ইচ্ছা নেই, এবং একটা রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়, সেইটার জন্য কী জবাব উনারা দেবেন আমি জানি না।

মূল সমস্যা হলো: এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে ধরে নেওয়া হচ্ছে, যে সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে বা যে গুলো বাস্তবায়ন করতে হবে সেগুলোর মধ্যে এমন কোন বিষয় রয়েছে যা ২০২৫-এর ডিসেম্বরের মধ্যে করা যাবে না, কিন্তু ঠিকই ২০২৬-এর জুনের মধ্যে করা যাবে। এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন। কারণ সংস্কারের এজেন্ডায় এমন কিছুই নেই যেটা শুধু ডিসেম্বরে করা যাবে না, অথচ ২০২৬-এর জুনের মধ্যে করা সম্ভব।
প্রস্তাবিত সংস্কারকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় যার কোনোটার জন্যই নির্বাচন পেছানোর যৌক্তিকতা নেই।
ভাগ দুটি হলোঃ 
১. এমন সংস্কার যেগুলোর সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেইঃ
* যেমন প্রশাসনিক আদেশ, অধ্যাদেশ বা সরকারি সিদ্ধান্ত যেগুলো অন্তঃমন্ত্রণালয় বাস্তবায়নযোগ্য।
* রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে, এগুলো অবিলম্বে কার্যকর করা যায় — ডিসেম্বর নয়, আগামী সপ্তাহ থেকেই শুরু করা যাবে।

২. এমন সংস্কার যেগুলোর সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন আছেঃ
* যেমন পরবর্তীকালীন বাস্তবায়নের জন্য সংসদের নির্বাচিত সংসদ প্রয়োজন,
* এইগুলোর জন্যে নির্বাচন পেছানো তো দূরের কথা, এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের জন্যে নির্বাচন পূর্বশর্ত।
অর্থাৎ, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে যে সংস্কারগুলোর সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা নেই, সেইগুলো আলোচনা শেষে এখনই করে ফেলা যায়। আর যেগুলোর জন্যে সংসদে বিল পাস বা সংবিধান সংশোধন করতে হবে, তার জন্য নির্বাচন বিলম্বের কোনো সুযোগ নেই। কারণ সেইগুলো বাস্তবায়ন করতেই নির্বাচন প্রয়োজন।

এগুলো ছাড়াও কাঠামোগত সংস্কারের অনেক গুলো বিষয় আছে যার জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে , জনবল পরিবর্তন করতে হবে, বিভিন্ন ধরনের স্টেক হোল্ডার এঙ্গেজমেন্ট করতে হবে অর্থাৎ চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান করতে হবে । আমার প্রশ্ন কাঠামোগত সংস্কার যেগুলোতে লাগবে সেগুলোর জন্য কি আগামী বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে? তারমানে কিসের ভিত্তিতে আমরা ধরে নিবো যে এই সংস্কারগুলো ২০২৬ এর জুনের আগে করার কোন ইচ্ছা বা পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে ? তার মানে এই প্রস্তাবগুলো ২০২৬ সালের বাজেটের আগে বাস্তবায়ন হবে না। ফলে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সম্ভাব্য বাস্তবসম্মত পথ কী হতে পারে?

এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হলো একটি স্পষ্ট ও সমন্বিত প্রক্রিয়া:
* সকল প্রধান রাজনৈতিক দলকে একসাথে এক টেবিলে বসে, তাদের প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে। 
* আলোচনা টা হবে উন্মুক্ত ভাবে একটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে । 
* আলোচনাতে একটি কমন বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্যাকেজ চূড়ান্ত করা হবে। 
* যা এখন বাস্তবায়নযোগ্য তা অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অবিলম্বে করা হবে। 
* যে প্রস্তাবগুলোর জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে, তার জন্য নির্বাচন দ্রুত আয়োজন করতে হবে।

ফলে সকল পক্ষের সাথে আলোচনায় বসে যদি সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি করা গেলে বর্তমান অচলাবস্থার থেকে মুক্তির পথ তৈরি হবে। সেটা করতে গেলে প্রফেসর ইউনুসের ইগোতে কেন আঘাত লাগবে, আমি বুঝতে পারছি না। এটা আমাদের প্রশ্ন করতে হবে , ৩ মাস আগে কমিশন গুলো প্রায় ৫০ পাতার আশু বাস্তবায়নযোগ্য যে প্রস্তাব গুলো পাঠিয়েছে যার কিছুই কেন এগোয়নি। 

আন্দোলনের সময়ে পুলিশের করা হত্যার, বুলেট ও আরমসের কোন ডিপার্টমেন্টাল ইনভেস্টিগেশন কেন এখনো হয় নাই। কোন কমিশন এই গুলো করে দিবে ? এগুলো তো সরকার এখনই করতে পারে।  আর বেশি সংস্কার বা কম সংস্কারের নিক্তিটা কী ? ফলে “কম সংস্কার মানে ডিসেম্বরে, বেশি সংস্কার মানে জুন”—এই যুক্তি প্রফেসর ইউনুসকে কে শিখিয়েছে, তার সাথে আমি একটা টকশো করতে চাই। এর মাধ্যমে নির্বাচনকে যে সংস্কারের মুখোমুখি দাড় করানো হয়েছে তা একটা হাস্যকর যুক্তি ।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক জিয়া হাসান।