আলো-ছায়ার বনে এক অনামিকার গল্প: তালমাখনার জাদু
- ২৬ মে ২০২৫, ১১:৪৯
তাল কিংবা মাখনাফুল—দুইয়ের সঙ্গেই কোনো সাদৃশ্য নেই, অথচ নাম তার তালমাখনা! আবার কোথাও কোথাও এই গাছকে কুলেখাড়া নামেও ডাকা হয়। নামের রহস্য একদিকে, আর কার্যকারিতা আরেকদিকে—এই ভেষজ উদ্ভিদ যেন প্রকৃতির এক পরিপূর্ণ বিস্ময়।
তালমাখনার সঙ্গে প্রথম পরিচয় বইয়ের পাতায়, কিন্তু দেখার সুযোগ আসে অনেক পরে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধি উদ্ভিদ উদ্যানে। ফুলে-ফলে মোড়া বাগানের পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সুদৃশ্য গাছটি দেখে মনে হয়, যেন কোনো চিত্রশিল্পী রঙে রাঙিয়ে তুলেছেন প্রকৃতির ক্যানভাস। ওই উদ্যান ঘিরে বহু স্মৃতি জমেছে, বিশেষত বৃক্ষপ্রেমী যায়েদ আমীনের সঙ্গে গিয়েই সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর চোখে বাগানের প্রতিটি বৃক্ষ যেন জীবন্ত গল্পের চরিত্র।
তালমাখনা ও তালমূলী—দুই নামেই খানিকটা মিল থাকলেও, উদ্ভিদ দুটি আলাদা গোত্রের। ফলে দেখা ও ব্যবহারেও রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। অনেকেই এই দুইয়ের মধ্যে বিভ্রান্ত হন। তবে যাঁরা ভেষজ গুণাগুণ জানেন, তাঁরা তালমাখনার কথা বলতেই চোখ উজ্জ্বল করে ওঠেন।
ইউনানি চিকিৎসা শাস্ত্রে যার নাম তালমাখনা, আয়ুর্বেদে তার আরেক নাম—কোকিলাক্ষা। ছোটখাটো এই উদ্ভিদটির প্রতিটি অংশই ঔষধিগুণে ভরপুর। এর পাতা, ফুল, বীজ—সব কিছুতেই রয়েছে উপকারী রাসায়নিক উপাদান, যেমন অ্যালকালয়েড, স্টিগমাস্টেরল, লুপিয়ল, ফাইটোস্টেরল ইত্যাদি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর ছোট, খয়েরি বর্ণের বীজ। দেখতে অনেকটা তিলের মতো হলেও ভিজলে তা হয়ে ওঠে আঠালো ও চটচটে। তাই বীজে লুকিয়ে থাকে প্রকৃত শক্তি।
এই বীজ পুষ্টিকর, শুক্রবর্ধক ও স্নায়ুশক্তি বাড়াতে কার্যকর। লিউকোরিয়া, গেঁটে বাত, স্নায়বিক দুর্বলতা বা হজমের সমস্যা—প্রায় সব ক্ষেত্রেই তালমাখনার বীজ আশাব্যঞ্জক ফল দেয়। মাত্র তিন গ্রাম বীজচূর্ণের সঙ্গে অন্যান্য ভেষজ উপাদান মিশিয়ে নিয়মিত সেবনে শরীর ও মন পায় প্রশান্তি। তবে অতিরিক্ত সেবনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে নির্দিষ্ট মাত্রা মেনে চলাই বাঞ্ছনীয়।
তালমাখনা গাছ সাধারণত আধা মিটার থেকে এক মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়, কাণ্ড থেকে বের হয় অসংখ্য শাখা। ফুলের রঙ উজ্জ্বল বেগুনি লাল বা হালকা বেগুনি সাদা। বাংলার নিচু জলাভূমি, হাওর বা ডোবার ধারে বর্ষা শেষে হেমন্তে যখন মাটি কিছুটা শুকিয়ে আসে, তখন ফোটে এর ফুল। নভেম্বর থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত থাকে ফুলের ঋতু।
ইংরেজিতে গাছটির নাম Star Thorn, আর আমাদের কাছে যেন সে প্রকৃতির এক নীরব তারকা। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা বুনো প্রান্তরে এই ভেষজ গাছটি শুধু সৌন্দর্যই নয়, হয়ে ওঠে আমাদের পরম উপকারের সঙ্গী।
আধুনিক চিকিৎসায় যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক ওষুধের ভিড়ে এই একরত্তি গাছ যেন এক নির্ভরযোগ্য শৈলপ্রপাত—প্রাচীন মমতার ছোঁয়া বয়ে আনে শরীর ও মনের জন্য। তালমাখনার মতো হারিয়ে যেতে বসা ভেষজ গাছগুলোর সংরক্ষণ ও চাষাবাদ তাই সময়ের দাবি। প্রকৃতির কাছেই রয়েছে আমাদের শিকড়, আর তালমাখনার মতো গাছগুলো সেই শিকড়ের মাটিতেই আমাদের টেনে রাখে দৃঢ়ভাবে।