বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

১৪ বছরে ৫ ভিসি, তিনজনই আন্দোলনের মুখে পদ ছেড়েছেন

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ভিসি
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ভিসি © টিডিসি সম্পাদিত

দক্ষিণবঙ্গের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি)। বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৪ই জানুয়ারি ২০১১ সালে ৫৩ একর জায়গার উপর বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের পাশে কীর্তনখোলা নদীর তীরে কর্ণকাঠিতে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গত ১৪ বছরে ৫ জন উপাচার্য পরিবর্তন হয়, যার মধ্যে দুইজন তাদের চার বছরের পূর্ণাঙ্গ মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পেরেছেন। আর বাকি তিনজনই ছাত্রদের আন্দোলনে মুখে পরে; একজন পদত্যাগ করেন, আরেকজনকে অপসারণ করা হয় এবং অন্যজনকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক শুচিতা শরমিনকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে ২৪ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে দায়িত্ব অর্পিত করা হয়। কিন্তু গত (১৩ মে) শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাবেক এই উপাচার্যকে অপসারণ করেন।

তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নানান অভিযোগ ছিল; তিনি (১৬ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদেরকে ফ্যাসিস্ট আমলের বলে প্রথম বিতর্কের জন্ম দেন। পরবর্তীতে তিনি শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলন দমনের জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও জিডি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জেবুন্নেছা হক জিমি (মৃত) চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্যের আবেদন করেন। কিন্তু উপাচার্যের স্বাক্ষর না পাওয়ায় তিনি কোনো সাহায্য পাননি। অধ্যাপক শুচিতা শরমিনের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন করার অভিযোগও রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ উপাচার্য; যিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ থেকে সরাসরি উপাচার্য হলেন- অধ্যাপক মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া। কোষাধ্যক্ষ থেকে উপাচার্য হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোতে বিরল। তিনি ৪ই মার্চ ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মুখে তিনি নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণ দেখিয়ে ২০ই আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে পদত্যাগ করেন। 

তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ গুলো হলো- তিনি জুলাই আন্দোলনে সকল শিক্ষকদের নিয়ে এক জুম মিটিং করে বিতর্কের জন্ম দেন। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা তাকে ফ্যাসিস্টদের দোসর বলে আখ্যায়িত করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টির দ্বিতীয় উপাচার্য শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এস এম ইমামুল হক ১৫ই মে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে দায়িত্ব পান। জানা যায় তিনি সবচেয়ে বেশি আন্দোলনের মুখে পড়েন এবং শিক্ষকদের একাংশ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। দুই দফায় তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে একবার ১৫ দিন ও আরেকবার টানা ৪৪ দিন বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্বেচ্ছায় ছুটির আবেদন করেন। একপর্যায়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে বাধ্যতামূলক তিন মাসের ছুটিতে পাঠান। ছুটিতে থাকাকালীন তার মেয়াদ পূর্ণ হয়। তখন তার অনুপস্থিতিতে রুটিন দ্বায়িত্ব হিসেবে প্রাক্তন ট্রেজারার অধ্যাপক ড. এ কে এম মাহবুব হাসান দায়িত্ব পালন করেন।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো হলো- ২৬ মার্চ ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটি কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দেন এবং এর ঠিক ২৭ দিন পর লিখিতভাবে আবার শিক্ষার্থীদের ‘সন্ত্রাসী’ বলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল, ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক মো. হারুনর রশিদ খান এবং তৃতীয় উপাচার্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন। তারা দুইজন পূর্ণাঙ্গ মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘আমরা চার সেমিস্টারে চার জন ভিসি দেখতেছি। চারজনের মধ্যে দুইজনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। আমি মনে করি, তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনগুলো খুবই যৌক্তিক ছিল। যদিও ভিসিবিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়েছিল এবং অ্যাকাডেমিক শাটডাউন ঘটেছিল; যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করেছে। এইভাবে যদি বারবার ভিসি পরিবর্তন হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে বলে, আমি মনে করি।’

গত মঙ্গলবার (১৩ মে) বিশ্ববিদ্যালয়ে ষষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তৌফিক আলম। ১মে তিনি কার্যালয় যোগদান করেন। এই সময় গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “যেহেতু সরকার আমাকে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে নিয়োগ দিয়েছে, তাই আমি আমার সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করব বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে; যাতে বিশ্ববিদ্যালয় মান, মর্যাদা ও র‍্যাংকিংয়ে আরও এগিয়ে যেতে পারে।” 

ফ্যাসিবাদের দোসরদের নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “যেহেতু ফ্যাসিবাদের দোসর আছে কিনা আমি জানি না,  যদি থেকে থাকে এই ব্যাপারে জিরো টলারেন্স থাকবে আমার পক্ষ থেকে।”

যোগদানের পর তালাবদ্ধ বাসভবনের গেট থেকে শিকল খুলে মন্তব্য করেন, “এই শিকল তোমাদের হাতে দিয়ে গেলাম, আমার মাধ্যমে যদি কোনো অন্যায় পাও তাহলে আবার আটকায় দিয়ো।” 

তিনি গত (১৫ মে) রাতে একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ও শিক্ষার্থীর হল পরিদর্শন করেন এবং শিক্ষার্থীদের সাথে খাবার খান। তার এই শিক্ষার্থীবান্ধব আচরণ দেখে শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন।