কৃষি উন্নয়নে গবেষণা নাকি ভর্তুকি, জানাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর © টিডিসি ফটো

কৃষি গবেষণায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ পর্যন্ত গবেষণার মাধ্যমে ১১০টিরও বেশি জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। শুধু ধান নয়, অন্যান্য কৃষিপণ্য নিয়েও গবেষককেরা নিরন্তর কাজ করছেন। পেয়েছেন যুগান্তকারী নানা সাফল্য। এছাড়াও কৃষির উন্নয়নে, কৃষকের দুর্ভোগ লাঘবে কৃষিখাতে ভর্তুকিও দিচ্ছে সরকার। যার ফলে দেশের কৃষিতে অগ্রগতি ত্বরাণিত হয়েছে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে উদ্ভাবিত উন্নতমানের জাতের মধ্যে রয়েছে বিআর ৫২, ৫৯, ৮৯ এবং ১০২। অপরদিকে দেশের কৃষিতে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের চাহিদা স্থানীয় উৎপাদনের তুলনায় বেশি হওয়ায় প্রতি বছরই এই সার আমদানি করতে হয়। ফলে এসব সারের মূল্য প্রতিকেজিতে ৮০ থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত পড়ে। কিন্তু সরকার কৃষকের উৎপাদন ব্যয় সহনীয় রাখতে ভর্তুকির ব্যবস্থা রেখেছে। যাতে কৃষক মাত্র ২২ থেকে ৩০ টাকা দরে এই সার ক্রয় করতে পারে। একই সঙ্গে কৃষিতে বরাদ্দ, স্বচ্ছতা, কৃষি প্রযুক্তির দিকেও রাখতে হবে নজর। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের পরিচালক কৃষিবিদ মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘প্রতি বছর বাজেটে কিছু না কিছু ভিন্নতা থাকে, এবছরও তার ব্যতিক্রম নয়। এবারও প্রণোদনায় নতুনত্ব আনা হয়েছে। দেশীয় ফসল যেমন আলু ও পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য ছোট ছোট কোল্ড স্টোরেজ,এয়ার কুলিং ও মাল্টি-কোল্ড প্রযুক্তি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কৃষিতে গবেষণা
গবেষণা নিয়ে কৃষিবিদ মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, কৃষিতে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গবেষণা চলছে। আধুনিক চাহিদা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের কৃষি গবেষণা ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ১১০টিরও বেশি ধানের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এর মধ্যে অতীতের জনপ্রিয় জাতগুলো ছিল বিআর ১১, ২৮, ২৯ (যা সাধারণত 'চিল ধান' নামে পরিচিত)। এই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে উদ্ভাবিত উন্নতমানের জাতের মধ্যে রয়েছে বিআর ৫২, ৫৯, ৮৯ এবং ১০২। এগুলো উচ্চফলনশীল এবং প্রতিকূল পরিবেশেও সহনশীল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি জাত হলো বিআর ৭৪ যা জিঙ্কসমৃদ্ধ হওয়ায় এটি দেহের বৃদ্ধি এবং হজম প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। ফলে পুষ্টি ঘাটতি পূরণেও এটি কার্যকর ভূমিকা রাখছে। কৃষি উৎপাদন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। 

কৃষিতে ভর্তুকি
কৃষিতে ভর্তুকি নিয়ে কৃষিবিদ মো. হাবিবুল্লাহকে জিজ্ঞাস করলে তিনি বলেন, দেশের কৃষিতে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের চাহিদা স্থানীয় উৎপাদনের তুলনায় বেশি হওয়ায় প্রতি বছরই এই সার আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব সারের মূল্য প্রতিকেজিতে ৮০ থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত পড়ে। তবে সরকার কৃষকের উৎপাদন ব্যয় সহনীয় রাখতে ভর্তুকির ব্যবস্থা রেখেছে। এর ফলে কৃষক মাত্র ২২ থেকে ৩০ টাকা দরে এই সার ক্রয় করতে পারে। এভাবে ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাচ্ছে এবং কৃষকরা চাষাবাদে আগ্রহী থাকছেন। কৃষকদের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি ব্যবস্থাও চালু রাখতে হবে।  

আরও পড়ুন: টেকসই কৃষির জন্য ভর্তুকির চেয়ে জরুরি গবেষণা: ড. আনিছুজ্জামান চৌধুরী

বরাদ্ধ ও স্বচ্ছতা
কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায়ে কিভাবে বরাদ্দ ও স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করেন জিজ্ঞাস করলে কৃষিবিদ মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, কৃষিখাতে কেন্দ্রীয়ভাবে যে-সব বরাদ্দ দেওয়া হয় তা প্রান্তিক পর্যায়ে নির্ধারিত খাতে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যয় করা হয়ে থাকে। প্রতিটি ইউনিট আমাদের কাছে প্রতি মাসে তাদের ব্যয়ের বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠায়। এসব প্রতিবেদনে যদি কোথাও কোনো অসঙ্গতি বা স্বচ্ছতার অভাব পরিলক্ষিত হয় তাহলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করি। এ ছাড়া কৃষকদের স্বার্থ রক্ষাই আমাদের বরাদ্দের মূল উদ্দেশ্য। কখনো কখনো মাঠপর্যায়ে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। তবে আমরা তা গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করি এবং যথাসম্ভব দ্রুত ও কার্যকরভাবে তা নিরসনের চেষ্টা করি।

কৃষিতে প্রযুক্তি
কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে জিজ্ঞাস করলে হাবিবুল্লাহ বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কৃষিকে টেকসই ও উৎপাদনশীল করতে আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে। লক্ষ্য একটাই—কৃষি উৎপাদনে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের যথার্থ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। ইতোমধ্যে ধান, গম, ভুট্টা ও পাটের বিভিন্ন জাত উদ্ভাবিত হয়েছে, যার মধ্যে লবণাক্ততা, খরা ও বন্যা সহনশীল জাতগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এসব জাত ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে, দেশের হাওর অঞ্চলে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে—এখন সেখানে ১০০ শতাংশ ধান চাষ যন্ত্রের মাধ্যমে করা হচ্ছে। কৃষকরা আগ্রহের সঙ্গে সিডার, ট্রান্সপ্লান্টার এবং উন্নত সেচ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। এটি উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনে এবং ফলনও বৃদ্ধি করে। এই প্রযুক্তিগুলোর সঠিক ও দক্ষ ব্যবহারের জন্য উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ফলে কৃষকরা হাতে-কলমে শেখার সুযোগ পান এবং প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।

আরও পড়ুন: অনিয়ম, বণ্টন ও নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিয়ে যা জানাল খাদ্য অধিদপ্তর

কৃষকদের অসন্তোষ
দেশীয় কৃষকরা মাঝে মাঝে ফসলের প্রত্যাশিত মূল্য পায় না। ফলে তাদের মধ্যে দেখা যায় অসন্তোষ এ নিয়ে পরিচালকের কাছে জিজ্ঞাস করলে তিনি বলেন, এটা সত্যি অনেক সময় দেশীয় কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের প্রত্যাশিত মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। সিজনের সময়গুলোতে যখন সরবরাহ বেড়ে যায় তখন বাজারে দামের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। তবে এই পরিস্থিতি সবসময় নয়, মূলত তা চাহিদা ও সরবরাহের অস্থায়ী অসামঞ্জস্যের কারণে ঘটে থাকে। এ ধরনের সমস্যা নিরসনে সরকার কৃষিপণ্য সংরক্ষণের টেকসই ও কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কাজ করছে। ফলে কৃষকেরা বাজারমূল্য পড়ে যাওয়ার সময় তাৎক্ষণিক বিক্রয়ের পরিবর্তে ফসল মজুদ রাখতে পারেন এবং সুবিধাজনক সময়ে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারেন। পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিশ্চিতকরণ এবং টেকসই খাদ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর লক্ষ্য শুধু উৎপাদন বাড়ানো নয় বরং জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও কৃষকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা একসঙ্গে নিশ্চিত করা।