দেশে ৩০ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার মতো মানসম্মত শিক্ষক আছে
- ২১ জুন ২০২৫, ১৪:০৪
বাংলাদেশে কি ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার মতো যথেষ্ট সংখ্যক মানসম্মত শিক্ষক আছে বা ছিল? আমি বড় জোর ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার মত মোটামুটি মানসম্মত শিক্ষক দেখি। তাও এই ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধিকাংশই বিশ্বমানের হবে কিনা সন্দেহ। এই অবস্থায় আমরা যত্রতত্র মানহীন এত এত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে ফেলেছি। ফলে পদ পূরণের জন্য শিক্ষক হওয়ার মত যোগ্যতা যার নেই, তাদেরকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানিয়ে ফেলেছি। এই অযোগ্যরা শিক্ষকতা করার চেয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে বেশি।
আমাদের ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ মানুষ এসব শিক্ষকদের টেলিভিশনের টক্মা-শোতে অনর্গল মিথ্যা বলতে দেখেন, রাজনৈতিক নেতাদের পেছনে ঘুরঘুর করতে দেখেন, এমনকি জাতীয় নির্বাচন এলে দলীয় প্রার্থীদের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাদের পক্ষে ভোট ভিক্ষা করতে দেখেছে। শিক্ষক নামের এই অশিক্ষকদের দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে সমাজে যেই পার্সেপশন তৈরি হয়েছে, তা মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে মারাত্মক প্রতিবন্ধক।
এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই প্ৰযোজ্য তা নয়। শিক্ষার সকল স্তরের শিক্ষকরাই আজ এমন। এই শিক্ষকদের কারণে যৌন হয়রানি, প্রকাশনা চাপের কারনে চৌর্যবৃত্তি, বেতন কম হওয়ার কারণে পার্ট টাইম রাজনীতি বা অন্য কিছুতে মন বেশি ব্যস্ত।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো এত প্রশাসনপ্রীতি সম্ভবত পৃথিবীর আর কোথাও নাই। সবাই ভিসি, প্রোভিসি, ইউজিসি ও পিএসসির চেয়ারম্যান মেম্বার হতে চায়। এতই যদি প্রশাসন ভালো লাগে তাহলে শিক্ষক হয়েছিলেন কেন? পৃথিবীর অন্যত্র শিক্ষা ও গবেষণায় শিক্ষকরা এক পর্যায়ে যখন বুঝতে পারেন এই দিকে ভালো করবেন না তখন ট্র্যাক পরিবর্তন করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যারিয়ারে ঢুকে। শিক্ষকতা ও গবেষণার চেয়ে ভালো কিছু কি আর আছে?
গবেষণা করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবেন, আর সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দেবেন। এর চেয়ে আনন্দের কাজ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নাই। এই যে প্রশাসনে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা এটাই প্রমাণ করে আমাদের শিক্ষকরা কতটা অযোগ্য। প্রশাসনে যেতে পারেন অবসরের পর বা ক্যারিয়ারের একদম শেষ দিকে। আমি দেখেছি, পিএইচডি শেষ করেছে খুব বেশি দিন হয়নি অথচ এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে বসে আছে। তার এই পিএইচডি-র কি মূল্য আছে?
পিএইচডি শেষে ক্লাসে পড়াবে, ছাত্রদের গবেষণা করাবে ও নিজে করবে। তা না করে পদ করে নামের আগে ড. লাগিয়েই এইটাকে অলংকার হিসাবে ব্যবহার করে রাজনীতি আর পদ-পদবির পেছনে দৌঁড় শুরু হয়ে যায়।
আরো পড়ুন: ইউরোপা লিগ সেমিফাইনালসহ টিভিতে যা দেখবেন
আসলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা শুধু পিএইচডি না, ন্যূনতম দুই বছরের পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা আছে এবং সেই সময়ের মধ্যে ন্যূনতম ১২ বা তার অধিক প্রকাশিত গবেষণাপত্র আছে তাদের। অথচ আমাদের দেশের অধ্যাপক হিসাবে প্রমোশনের ন্যূনতম যোগ্যতা ১২টি আর্টিকেল। তাদেরকেই কেবল নিয়োগের জন্য যোগ্য বিবেচনা করা হয়? আমাদের দেশের কথা ভেবে না হয় পিএইচডি কেই ন্যূনতম যোগ্যতা ধরতে পারি।
অন্তত পিএইচডিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা ধরুন। দেশের অন্তত প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পোস্ট-ডক নিয়োগের ব্যবস্থা করুন। বিশ্বমানের পোস্ট-ডক নিয়োগ দিতে হলে পোস্ট ডক ফেললোশিপের মানও সেইরকম হওয়া উচিত। ভারতে পোস্ট-ডক বাংলাদেশি টাকায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা, সঙ্গে অন্যান্য সুবিধাতো আছেই। আর পিএইচডি ফেলোশিপ ৬০ হাজার থেকে ৮০হাজার। আর আমার দেশে সহকারী অধ্যাপক পায় ৫০ হাজার টাকা।
কি আশা করেন তাহলে? বুঝতে পারছেন যে, শিক্ষার মান বাড়াতে হলে গোটা শিক্ষকদের বেতন কাঠামোকেই ওপরে তুলতে হবে। এ জন্যই ইউনেস্কো বলে. শিক্ষায় জিডিপির ন্যূনতম ৫.৫ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। পৃথিবীর যেসব দেশ উন্নত হয়েছে, এইটা করেই উন্নত হয়েছে। জিডিপির ১.৬৯ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে উন্নত জাতি হওয়ার অলীক স্বপ্ন জাতিকে ধ্বংস করছে।
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
(ফেসবুক থেকে নেওয়া)