ঋতুর সঙ্গে বদলে যাওয়া জীবন: হাকালুকির জল, মাটি ও মানুষের গল্প
- ২২ জুন ২০২৫, ১৫:১০
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় হাওর বাংলাদেশের হাকালুকি হাওর। অসংখ্য জীবনের গল্প রচিত হয় এ হাওরে৷ এক ঋতুতে হাওরটি হয়ে ওঠে দরিয়ার প্রান্তর, তখন হাওরপারের মানুষগুলো নিজেদের বানিয়ে ফেলে সিন্দাবাদের মাঝি। অন্য ঋতুতে বিশাল জলরাশি শুকিয়ে পরিণত হয় বিস্তৃত হরিৎ জমিনে, তখন এই সংগ্রামী মানুষেরাই আবার হয়ে ওঠে লাঙল কাঁধে কৃষক।
সকালবেলায় হাওরে পৌঁছালে প্রথম যে শব্দ কানে আসে, তা নিস্তব্ধতার। অথচ সে নিস্তব্ধতা যেন শস্যের মতো জন্ম নেয় হাজারো শব্দের ভেতর। ঢেউয়ের গর্জন নয়, বরং নৌকার বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা হাসির গুঞ্জন, আর মাঝেমধ্যে হাওরের বুক চিরে ভেসে চলা একটি কিশোরের গান—এসব নিয়েই তৈরি হয় হাকালুকির সকাল।
হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের এক মমতাময়ী হাওর। এর আয়তন প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর, যা মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার পাঁচটি উপজেলায় বিস্তৃত। প্রতিবছর বর্ষায় এটি রূপ নেয় এক বিশাল জলরাজ্যে, যেখানে আকাশ আর জল মিলে যায় একে অপরের প্রতিচ্ছবিতে। এখানকার মানুষ এ জলেই গড়ে তোলে তাদের জীবন। জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে, কাজ করে, আবার অনেকে হারিয়ে যায় হাওরেরই অতলে।
হাওরপারের মানুষ একেক ঋতুতে একেক রকম
বর্ষাকালের ভরা যৌবনের অথই পানিতে হাকালুকি হাওর পরিণত হয় বিশাল জলরাশীর সফেদ দরিয়ায়। তখন হাওর হয়ে যায় মাছের আবাসভূমি। ঋতুবৈচিত্রের আশীর্বাদে শীতকালে পানি শুকিয়ে হাওরটি পরিণত হয় সবুজ চারণভূমিতে। গৃহপালিত পশুপাখি তখন হাওরে বিচরণ করে। সেখানেই গড়ে ওঠে এক অন্য রকম জীবন।
‘জল দেইখা বুঝি কই মাছ আছে’—বলছিলেন গোলাপগঞ্জ উপজেলার কালীকৃষ্ণপুর গ্রামের অলেক মিয়া। ৫০ পেরিয়ে যাওয়া এই মানুষটির চোখে হাওরের মতোই প্রশান্তি। ‘এই হাওরে বড় হইছি। মাছই আমার সংসার চালায়।’
বর্ষাকালে হাকালুকির জলরাশি ছুঁয়ে ফেলে ঘরের দোরগোড়া। তখন গাছের গোড়ায়, উঠোনের ধারে, এমনকি রান্নাঘরের চৌকাঠেও দেখা মেলে মাছের। কিশোরেরা ডুবে যায় মাছ ধরায়, মেয়েরা নৌকার বুকে বসে বুনে যায় জালের জ্যামিতি। ঘড়ের দোয়ারে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে নতুন বউটি।
শীত এলে হাওর শুকিয়ে যায়। পানি কমে গিয়ে উন্মুক্ত হয় তলদেশ আর তখন সেই কৃষিজমিতে ধান চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এখানকার মানুষ। জমিন চষা, বীজ রোপণ, কাটা, মাড়াই—সব কাজই চলে ঠেলাঠেলি করে। কারণ সময় স্বল্প আর প্রকৃতি অপেক্ষা করে না।
ষড়ঋতুতে হাওরের রূপ
হাকালুকি হাওর ছয় ঋতুতে ছয় রূপে আবির্ভূত হয়। প্রতিটি রূপে যেন সে এক নতুন কবিতা, এক নতুন চিত্রকল্প।
গ্রীষ্মে হাওরের বুক শুকিয়ে ফাটল ধরে, চর জেগে ওঠে, সূর্য যেন তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলছে তার প্রান্তরে।
বর্ষায় সে আবার বিশাল জলরাশিতে রূপ নেয়, দূরের গ্রামগুলো ভেসে থাকে সবুজ নৌকার মতো।
শরতে সাদা কাশফুল আর তুলোর মতো মেঘে আকাশভরা হাওর যেন হয়ে ওঠে নিখুঁত নিসর্গচিত্র।
হেমন্তে সোনালি ধানের হাসি ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে, কৃষকের মুখে ফুটে ওঠে সন্তুষ্টির রেখা।
শীতে অতিথি পাখির কলকাকলিতে হাওর হয়ে ওঠে জীবনের এক অভয়াশ্রম, এক নিঃসঙ্গ অথচ প্রাণবন্ত আলাপন।
বসন্তে নতুন কুঁড়ির গন্ধ আর রঙের উল্লাসে সে ফিরে পায় তার কিশোরী প্রাণ, নতুন করে গড়তে থাকে তার সৌন্দর্যের ছন্দ। এই ছয় ঋতুর ছয় ছোঁয়ায় হাকালুকি হাওর হয়ে ওঠে প্রকৃতির এক পরিপূর্ণ কবিতা।
উৎসব আর প্রেম
হাওর মানেই শুধু শ্রম আর সংগ্রাম নয়—এখানে উৎসবও আছে। নৌকা বাইচ, বর্ষা মেলা, নবান্নের উৎসব—এসব আয়োজন হাওরের ছন্দে তাল মেলায়। আর প্রেম? হাওরের কিনারে বসে অজস্র প্রেম কাহিনি লেখা হয়। নৌকার পাটাতনে, ছেলেটির গলায় বাঁশি বাজে, আর মেয়েটি খোপায় গাঁথে শিউলি ফুল। কবি জসীমউদ্দিনের অমর কীর্তি 'নকশী কাঁথার মাঠ' আর কবি ফররুখ আহমদের ‘সিন্ধু দরিয়া’ যেন হাকালুকি হাওর পাড়ের মানুষের বাস্তব প্রেম-জীবনের এক চিরন্তন প্রতিচ্ছবি।
প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা
শীতকালে হাওরে উৎপাদন করে হয় বিভিন্ন ধরনের ফসল। শর্ষে ফুল আর সূর্যমুখী ফুলের সুবাসে মুখর হয়ে থাকে হাওরের মৃদু বাতাস। হাওরের সবুজাভ বন, হলুদ ফুল আর সূর্যের কিরণ রশ্মির উদ্ভাসিত আলোর মিশ্রণে এক অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয় হাকালুকি হাওর।
হাকালুকি শুধু জীববৈচিত্র্যের আধার নয়, এটি রামসার স্বীকৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। হাওরজুড়ে রয়েছে ছোট-বড় অনেক বিল। এখানে পাওয়া যায় প্রায় ৪৭ প্রজাতির মাছ, ১১০ প্রজাতির পাখি, যার মধ্যে অনেক পরিযায়ী পাখিও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সেই সম্পদ আজ বিপন্ন। অনিয়ন্ত্রিত হাওর ব্যাবস্থাপনা, ব্যাক্তি ক্ষমতার অন্যায় হস্তক্ষেপ, অপরিকল্পিত পর্যটন, শিল্পবর্জ্য আর সরকারি নজরদারির অভাবে হাওর তার ভারসাম্য হারাচ্ছে।
জীবনধারণের সংগ্রাম: নারী-পুরুষের গড়া সংসার
হাকালুকি হাওরের মানুষদের জীবন মানেই প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াই। বর্ষায় মাছ ধরা আর শীতকালে ফসল উৎপাদন করাই তাদের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম পাথেয়। ঝড়-ঝঞ্ঝায় মাছ শিকার আর অকাল বন্যার আগেই হাওরপারের কৃষকরা হাড়ভাঙা খাটুনি করে, সময়ের বিপক্ষে ছুটে ফসল তোলে। এই ধান আর মাছই তাদের সারা বছরের চাল, ছেলের স্কুলের খরচ, মেয়ের বিয়ের জমানো টাকাও।
হাকালুকির নারী মানে শুধু ঘরের ভেতরে সীমাবদ্ধ কোনো চরিত্র নয়—তারা হাওরের ছায়ায় গড়ে তোলে জীবনের ভিত। পুরুষেরা মাছ ধরতে গেলে নারীরাই চালিয়ে নেয় সংসারের রসদ, দেখভাল করে সন্তানদের। সকালে ভোরবেলায় হাঁস-মুরগির ডাকের মাঝে তারা বেছে নেয় চাল, কেটে রাখে পুঁই শাক, আর দুপুরে ভর্তার থালায় সাজিয়ে রাখে সেই হাওরেরই স্বাদ।
বর্ষায় যখন হাওর পূর্ণ জলে, তখন মাছই প্রধান জীবিকা। ছোট-বড় নৌকা বেয়ে পুরুষেরা পাড়ি জমায় গভীর হাওরের দিকে, অনেক সময় দিনের পর দিন থেকে যায় পানির রাজ্যে। তাদের না ফেরা মানেই সেই পরিবারের চুলায় আগুন না জ্বলা এবং নারীদের মনে তখন উঁকি দেয় নানান দুঃশ্চিন্তার হাতছানি।
বিভিন্ন উৎসব, আয়োজনে পুরুষেরাই কর্তা। নতুন পোশাক পরিধান, আত্মীয়ের সাথে খোশগল্প আর চিরাচরিত বাংলার আনন্দে হেসে উঠে তারা। বিয়ের মৌসুমে বা উৎসবের সময় তারা আসে হাওরের পাড়ে, সাজে নতুন শাড়িতে, মাথায় রাখে তাজা ফুল। হাসি ছড়িয়ে পড়ে জলে, আর নারীরাও হয়ে ওঠে হাওরের প্রাণ।
প্রকৃতি, প্রশাসন ও প্রযুক্তি সবই অনিশ্চিত
হাকালুকি হাওরের মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রকৃতির অনিশ্চয়তা। আগে মৌসুমি বর্ষা ছিল পূর্বানুমেয়। এখন হঠাৎ বন্যা, অকাল বৃষ্টি, খরায় তাদের সব হিসাব এলোমেলো করে দেয়। মানুষের ঘরবাড়ি তলিয়ে যায় হিংস্র পানির ভয়াল আগ্রাসনে। বন্যা প্লাবিত অঞ্চলের মানুষসহ পশু-পাখিরাও জীবনযাপন করার জন্য একটু স্থলভূমি পায় না। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাঝেমধ্যে হয় না, প্রতিবছরই হাকালুকি হাওরপারের মানুষেরা বন্যাকবলিত হয়।
অনেক সময় ধান পাকে না-পাকেই তলিয়ে যায় পানির নিচে। তখন ফসলহানিকবলিত কৃষক বেঁচে থাকার জন্য যথাযথ খাবার পায় না। জুড়ি উপজেলার বেলাগাঁও গ্রামের কৃষক বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘ধান ক্ষেত করার জন্য আমদের বহুত টাক-পয়সা খরচ করতে হয়। অনেক সময় ঋণ করে, কিস্তিতে টাকা তুলেও আমরা ফসল ফলাতে ব্যয় করি। কিন্তু অকাল বন্যায় আমাদের ফসলগুলো পানিতে ডুবিয়ে দেয়। ফলে আমাদের গুনতে অনেক ক্ষতির হিসাব। অনেকে নিঃস্বপ্রায় হয়ে যায়।’
আর জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়ার কারণে মাছও কমেছে। আগে যেখানে একজাল ফেলে ৫-৬ রকম মাছ উঠত, এখন সেই জায়গায় মাছের দেখা মেলে না, কারণ হাওরে নেমেছে দূষণ আর অতিমাত্রায় শিকার।
‘আগে তো গাঙ্গেই অনেক মাছ পাইতাম। অহন আর এতো বেশি মাছ পাওয়া যায় না’ বলছিলেন- বড়লেখা উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের দুদু মিয়া। তিনি বলেন, ‘দিন দিন মাছের সংখ্যা কইম্মা যাইতাছে। বহুত জাতের মাছ এহন আর দেহাই যায় না।’
তবে এখানেও আছে নীরব প্রতিবাদ—হাওরপারের মানুষদের মুখে উচ্চারিত হয় না সব কথা। জলবায়ু পরিবর্তনে বদলে যাচ্ছে জলচিত্র, অকাল বন্যায় ভেসে যায় ফসল, মাছের অভাবে দিন চলে না। তারপরও তারা হেরে যায় না। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে সহাবস্থানের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাদের করেছে দৃঢ়, নীরব কিন্তু ন্যায়ের পথে স্থির।
প্রশাসনিক পরিকল্পনার অভাব এবং প্রযুক্তির সংকট হাওরবাসীর অবস্থাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। পর্যাপ্ত হাওরবান্ধব রাস্তা নেই, স্বাস্থ্যসেবা নেই, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও দুর্বল। শিক্ষার্থীদের অনেক সময় নৌকায় স্কুলে যেতে হয়, কিন্তু দুর্ঘটনার ভয় সদা-সচল।
সম্ভাবনার জলধারা
এ বিপদের মধ্যেও বিশাল সম্ভাবনার আলো আছে। ইকো-ট্যুরিজম, স্থানীয় কারুশিল্প, মাছের খামার, এবং হাওর সংরক্ষণে কমিউনিটি উদ্যোগ অনেকেই নিচ্ছেন। তরুণরা অনেকে ফিরে আসছেন গ্রামে—নতুন পদ্ধতিতে চাষাবাদ, হ্যাচারি, হোমস্টে ভিত্তিক পর্যটন খুলে দিচ্ছেন সম্ভাবনার দরজা।
হাওরবাসী নারীরাও এগিয়ে আসছেন। কেউ কেউ হাঁস পালন করছেন, কেউবা পাটের ব্যাগ তৈরি করে বিক্রি করছেন হাটে। আর তাদের চোখে যে আত্মবিশ্বাস, তা প্রমাণ করে, হাওরের বুকেই গড়ে উঠতে পারে এক নবজাগরণের ছবি।
হাওরের জলে গাঁথা জীবনের গল্প
হাকালুকি হাওর কেবল একটি ভূগোল নয়, এ এক চেতনার ভূখন্ড, যেখানে মানুষ আর প্রকৃতি পরস্পরকে ধারণ করে বেঁচে থাকে। এখানে হাওরের কল্লোলে লেখা হয় স্বপ্ন, কাদায় জমা থাকে জীবনের গৌরবগাথা।
যারা হাকালুকিকে চেনে, তারা জানে এ হাওরকে ভালো না বেসে উপায় নেই। আর যারা চেনে না, তাদের জন্য এ হাওরের ডাক—একটি নীরব আমন্ত্রণ। একবার এসে দেখো, কেমন করে জীবনের প্রতিটি স্তর জলে ভেসে ওঠে, আবার কেমন করে ভালোবাসা চুপি চুপি গড়িয়ে পড়ে হাওরের বুক বেয়ে।