৫৫ বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

জাবি

রাজধানী ঢাকার অদূরে সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও লাল ইটে তৈরি বাংলাদেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এটি বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার এক অনন্য সংযোজন। আজ ১২ জানুয়ারি (রবিবার) বিশ্ববিদ্যালয়টির ৫৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গত ৫৪ বছর থেকে উচ্চ শিক্ষা, গবেষণাসহ দেশ গঠনে অনন্য অগ্রগামী ভূমিকা রেখে আসছে এই বিদ্যাপীঠ।

১৯৭১ সালে ১২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। এর নামকরণ করা হয় মোঘল আমলে বাংলার রাজধানী ‘জাহাঙ্গীরনগর’ এর নামানুসারে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট পাস করে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে নাম রাখা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 

৬৯৭.৫৬ একর (২.৮ বর্গকিলোমিটার) জায়গাজুড়ে বিস্তৃত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটির উত্তরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, উত্তর-পূর্বে সাভার সেনানিবাস, দক্ষিণে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং পূর্বে দেশের কেন্দ্রীয় দুগ্ধ উৎপাদন খামার (ডেইরি ফার্ম) অবস্থিত।

বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৭০-৭১ শিক্ষাবর্ষে (প্রথম ব্যাচ) গণিত, পরিসংখ্যান, অর্থনীতি ও ভূগোল এই চারটি বিভাগ ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৬ টি অনুষদের অধীনে ৩৪ টি বিভাগ এবং ৪ টি ইনস্টিটিউট চালু আছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র, ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র ও সেন্টার অব এক্সিলেন্স ইন টিচিং অ্যান্ড লার্নিং।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের প্রথম নৃবিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের একমাত্র প্রত্নতত্ত্ব বিভাগও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালটিতে নির্মিত হচ্ছে বিশ্বমানের গ্রন্থাগার। ছয় তলা বিশিষ্ট লাইব্রেরিটি নির্মাণ শেষে  হবে বাংলাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরি। সেখানে আধুনিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এবং একসাথে প্রায় ৭-৮ হাজার শিক্ষার্থী পড়তে পারবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ‘ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জীববৈচিত্র্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি সবার কাছে সাংস্কৃতিক রাজধানী নামে সমাদৃত। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছোট-বড় সব মিলিয়ে প্রায় ২৬টি লেক রয়েছে। মূলত লেক ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বর্ধিত হয় এবং তা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। লেকসমূহে বিভিন্ন ধরনের জলীয় ফুল দেখতে পাওয়া যায়, এর মধ্যে লাল শাপলা, রক্তকমল শাপলা, পদ্মফুল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মূলত এই লেকসমূহকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর শীতকালে হিমালয়ের উত্তরের দেশ সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া ও নেপাল, ভারত, জিনজিয়াং থেকে পরিযায়ী পাখি আসে। এ সময় লেকসমূহ সৌন্দর্যের স্বমহিমায় আবর্তিত হয়। লেকের সৌন্দর্যে বিমোহিত হন শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা। পাখি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় পাখিমেলা। এ ছাড়া এখানে রয়েছে প্রজাপতির সংরক্ষণ ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য ‘প্রজাপতি পার্ক’। প্রজাপতি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় ‘প্রজাপতি মেলা’। 

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে তিন স্তম্ভ বিশিষ্ট বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনার। তিনটি স্তম্ভের একটি বাংলাভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অপর দুইটি মাটি ও মানুষ এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য সংশপ্তক। এই ভাস্কর্যে একপা ও এক হাত হারিয়েও এক সংশপ্তক মুক্তিযোদ্ধা বিজয়ের হাতিয়ার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও রয়েছে  ভাষা আন্দোলনের স্মরণে ভাস্কর্য ‘অমর একুশ’।

প্রাচীন গ্রিসের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মুক্তমঞ্চও রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন গ্রিসের নাট্যমঞ্চের আদলে লাল সিরামিক ইট দিয়ে নির্মিত খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত মঞ্চটির নাম দেওয়া হয়েছে বিখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীনের নামানুসারে। 

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে আবাসিক আসন। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছেলে শিক্ষার্থীদের জন্য ১১টি ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ১০টি উন্নত সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন আবাসিক হল রয়েছে। 

প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রেখে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্বসেরা ২ শতাংশ গবেষকের তালিকায় একাধিকবার বেশ কয়েকজন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নাম এসেছে। এছাড়া যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ (টিএইচই) – এর ওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিং-২০২৪ এ এককভাবে প্রথম এবং ২০২৫ এ যৌথভাবে দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। 

মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থান পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকা অনবদ্য। বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৭১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু করলেও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভূমিকা পালন করে। সর্বশেষ জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সর্বপ্রথম বর্তমান নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে এবং সর্বপ্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই আওয়ামী সরকারের দেওয়া কারফিউ ভঙ্গ করে রাজপথে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে প্রথম নির্মিত জুলাই ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। 

গত ৫৪ বছরের পরিক্রমায় বিশ্ববিদ্যালয়টি পেয়েছে অসংখ্য গুণী মানুষের সংস্পর্শ। তাদের মধ্যে রয়েছে কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, নাট্যকার, অর্থনীতিবিদ, খেলোয়াড়। এদের মধ্যে প্রখ্যাত কবি সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, লেখক হায়াৎ মামুদ, লেখক হুমায়ুন আজাদ, চলচ্চিত্র পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার দীপঙ্কর দীপন, নাট্যকার সেলিম আল দীন, আনু মোহাম্মদ, মোহাম্মদ রফিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আনু মুহাম্মদ, অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি, শহীদুজ্জামান সেলিম, জাকিয়া বারী মম, সজল নূর, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম প্রমুখ অন্যতম।