
ভোটার তালিকার বিষয়ে সঠিক পরামর্শ পাননি প্রধান উপদেষ্টা
- ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:৩৯

বাংলাদেশের বিদ্যমান ছবিসহ ভোটার তালিকার বিষয়ে সঠিক পরামর্শ পাননি প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস। ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজটিও কঠিন নয়। আমাদের যে ভোটার তালিকা তা ত্রুটিপূর্ণ নয়। প্রধান উপদেষ্টাকে ভোটার তালিকার বিষয়ে সম্পূর্ণ অসত্য এবং ত্রুটিপূর্ণ তথ্য দেয়া হয়েছে।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচনপ্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে আরও অন্তত ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘প্রথমে সবচেয়ে বড় কাজ ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। এটা এমনিতেই কঠিন কাজ। এখন কাজটা আরও কঠিন হলো এ জন্য যে গত তিনটা নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না।’
প্রধান উপদেষ্টাকে তথ্যদাতারা জানেন না যে, বাংলাদেশে যে ভোটার তালিকা তা ছবিসহ। যে বিগত ২০০৮ সালের এটিএম শামসুল হুদা কমিশন করেছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ ভোটার ডাটাবেজের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। দেশের সামরিক বাহিনীসহ বেসামরিক কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি ও পেশাজীবীর, সর্বোপরি দেশের জনগণের বিশাল কর্মযজ্ঞের ফসল এ ভোটার তালিকা। বেসরকারি সংস্থা ভোটার তালিকা নিরীক্ষা করে বলেছে ভোটার তালিকাটি ৯৯.৯৮ শতাংশ সঠিক। যেখানে ছবি, পুরো ঠিকানা ও বায়োমেট্রিক্স দিয়ে চেক করা, ফলে কোনো ভুল ভ্রান্তির স্কোপ থাকার কথা নয়। তবে একটি সমস্যা আছে সেটি হলো তথ্যভান্ডারে চাবি অরক্ষিত। এটির সুরক্ষা আগে নিশ্চিত করতে হবে। বিগত ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ কর্তৃক দাপিয়ে বেড়ানো প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির কাছ থেকে নির্বাচন কমিশনকে বের করতে হবে। এটাই কমিশনের এখন মুখ্য দায়িত্ব হওয়া উচিত।
আরও পড়ুন: নতুন বাংলাদেশ, নতুন সম্ভাবনা
ভোটার তালিকা হালনাগাদের আসলে কাজটি খুব কঠিন নয়। এটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। আইনে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক থাকায় ১৮ বছর বয়সী প্রত্যেক নাগরিককে ভোটার হতে হয়। যারা ভোটার তারাই মূলত জাতীয় পরিচয়পত্রধারী। এনআইডির ভিত্তিতে নির্ভুল ভোটার তালিকা করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। গত তিনটি নির্বাচনে যে মানুষ ভোট দিতে পারেননি, সেটা ভোটার তালিকার গরমিলের কারণে নয়, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হওয়ার কারণে। ভঙ্গুর নির্বাচন ব্যবস্থা ভোটারদের কেন্দ্রবিমুখ করেছে। একজনের ভোট আরেকজন দিয়েছে। সংবিধানে একদলীয় নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করার ফলে আমাদের দেশের জনগণ স্থায়ীভাবে ভোটাধিকার হারিয়ে ফেলে। এখানে ভোটার তালিকা নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। গত তিনটি নির্বাচনে প্রথম ভোটার হওয়া তরুণ-তরুণীরা ভোট না দিলেও তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। ফলে নির্ভুল ভোটার তালিকা করার কাজটি খুব কঠিন বলে যারা প্রধান উপদেষ্টাকে বুঝিয়েছেন, তারা ঠিক পরামর্শ দেননি। ভোটার তালিকার বিষয় অসত্য তথ্য দিয়েছেন।
ভোটার তালিকার জন্য নির্বাচন বিলম্বিত করানো সরকারের ভুল পদক্ষেপের অংশ। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ রেখেছেন। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছেন। কিন্তু তাতে সুস্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ নেই। প্রয়োজনীয় কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার করা হবে, সে জন্য কতটা সময় প্রয়োজন, তা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে স্পষ্ট নয়। তিনি বলেছেন, ‘যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে।’ এখানে চ্যালেঞ্জ করে বলা যেতে পারে অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকার জন্য নির্বাচন করতে এক বছর লাগার কথা নয়। সরকার সিদ্ধান্ত নিলে আগামী ২০২৫ সালের জুনের মধ্যেই অল্প সংস্কার করে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব। কেন এবং কি জন্য ভোটার তালিকার দোহায় দিয়ে এক বছর নির্বাচন বিলম্বিত করানো হচ্ছে সেটি বোধগম্য নয়।
আরও পড়ুন: শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এবং যে ষড়যন্ত্র একই সূত্রে গাথা
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ২ ডিসেম্বরের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২০২৪ সালের জন্য হালনাগাদ করা চূড়ান্ত ভোটার তালিকা আগামী ২ মার্চ প্রকাশ করা হবে। এরপর ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। ওই হালনাগাদে যাদের তথ্য সংগ্রহ করা হবে, তারা ২০২৬ সালের ২ মার্চের চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় (হালনাগাদ) অন্তর্ভুক্ত হবেন। ভোটার তালিকা আইন অনুযায়ী, প্রতিবছর ২ জানুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়। প্রতিবছর ২ জানুয়ারি তার আগের বছরের তথ্য নিয়ে হালনাগাদ ভোটার তালিকার খসড়া প্রকাশ করে ইসি। তালিকা নিয়ে দাবি, আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে ২ মার্চ প্রকাশ করা হয় চূড়ান্ত তালিকা। আগামী ২ মার্চ চলতি বছরের (২০২৪ সাল) তথ্য নিয়ে হালনাগাদ চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
আইনে হালনাগাদের বাইরে ইসিকে যেকোনো সময় ভোটার তালিকা সংশোধনের ক্ষমতাও দেওয়া আছে। কোনো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় পর্ব ছাড়া অন্য যেকোনো সময় নির্ধারিত পদ্ধতিতে, প্রয়োজন অনুসারে ভোটার তালিকা সংশোধন করতে পারে ইসি। এতে ভোটার হওয়ার যোগ্য কিন্তু বাদ পড়েছেন, এমন নাগরিকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা, মৃত বা ভোটার হওয়ার অযোগ্য ব্যক্তির নাম তালিকায় থাকলে সেগুলো বাদ দেওয়া, ভোটার এলাকা স্থানান্তর, তালিকার যেকোনো ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে সেগুলো দূর করার ক্ষমতা দেওয়া আছে।
এই আইনের ক্ষমতা বলে ভোটারযোগ্য ভোটার করার কার্যক্রম শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। ইতিমধ্যেই ভোটার করার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ভোটারের তথ্য সংগ্রহ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমদ। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ের মধ্যেই আমরা জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুত আছি। অন্যদিকে সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসিরউদ্দীন ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সরকার নির্বাচন আয়োজনের অনুমতি দিলে আমরা আগামী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে পারব। জাতীয় নির্বাচনের জন্য পুরোদমে প্রস্তুতি শুরু করেছি।’
আরও পড়ুন: শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস কেন একটি বিশেষ দিবস
বিদ্যমান সংবিধানের অধীন শপথ নিয়েছে নবগঠিত নির্বাচন কমিশন। সংবিধানের ১১৯ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ হলো, রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত থাকিবে।
আমাদের সংবিধানের ১২১ বলা আছে, ‘সংসদের নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার একটি করিয়া ভোটার-তালিকা থাকিবে এবং ধর্ম, জাত, বর্ণ ও নারী-পুরুষভেদের ভিত্তিতে ভোটারদের বিন্যস্ত করিয়া কোন বিশেষ ভোটার-তালিকা প্রণয়ন করা যাইবে না।" ২০০৮ সালে প্রদত্ত ছবিসহ ভোটার তালিকাটি সব ধর্ম, জাত, বর্ণ নারী-পুরুষের ভিত্তিতে নির্ভুল ভোটার তালিকা। এই বিদ্যমান ভোটার তালিকাটি করেছিল সশস্ত্র বাহিনী। অতএব ভোটার তালিকা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার তথ্য ভুলে ভরা।’
সংবিধানের ১২৩ (খ) বলা আছে, ‘মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন আয়োজনের জন্য সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে তিনমাসের সময় বেঁধে দিয়েছে। যেহেতু বর্তমানে সংসদ নাই, উচ্চ আদালতের নির্দেশে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাগ্রহণ করেছে। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ফ্যাসিবাদ শাসনে ক্ষমতাচ্যুতির পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার শপথ নিয়েছে। এই সরকারের মেয়াদও অনির্ধারিত। ফলে সরকারকে ঠিক করতে হবে তারা কতদিন ক্ষমতায় থাকবে? তারা যদি নির্বাচন কমিশনকে বা জাতিকে বলে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এই সরকার থাকবে তবুও এই সময়ের মধ্যে আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচন আয়োজনে কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা সরকারের মেয়াদ বাড়াতে কৌশলে ভোটার তালিকাকে সামনে এনে জাতির কাছে ভুল বার্তা পৌঁছেছেন।’
আরও পড়ুন: ডানপন্থীর বামে বামপন্থীর ডানে
সরকার সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে, ‘নির্বাচন কমিশনের কাজ নির্বাচন আয়োজন করা। আপনাদের কাজ সহযোগিতা করা। কিন্তু আপনারা যদি নির্বাচন আয়োজন করতে যান তাহলে নির্বাচন কমিশনের দরকার কি? ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার কাজও নির্বাচন কমিশনের। এটি সঠিক না বেঠিক সেটি নির্বাচন কমিশন জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার কাজটি কঠিন না সহজ সেটিও সরকারের কোন কাজ নয়। তাহলে সরকার প্রধানকে আগ বাড়িয়ে ভোটার তালিকার সহজ কাজকে জাতির সামনে কঠিনভাবে তুলে ধরার কোন দরকার আছে?’
লেখক : রাজনীতি ও নির্বাচন কমিশন-বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক