নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

ট্রাস্টি হিসেবে এসে বিশ্ববিদ্যালয় দখল আইবিএ পরিচালক ড. ইউসুফের

বিশ্ববিদ্যালয়
নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এনইউবি) বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের সদস্যরা

অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ। দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) পরিচালক হিসেবে। এর বাইরে বেসরকারি নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এনইউবি) বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের (বিওটি) চেয়ারম্যান তিনি। অভিযোগ উঠছে— অনেকটা জবর-দখল করে বেসরকারি এ বিশ্ববিদ্যালয়টির বিওটির চেয়ারম্যান হয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠাকালীন বোর্ড কব্জায় নিয়ে নিজ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গড়েছেন নতুন ট্রাস্টি বোর্ড।

বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন কয়েকজন ট্রাস্টি জানান, এক যুগেরও বেশি সময় আগে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলের পথ সুগম করে দিয়েছিলেন শিক্ষালয়টির প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের একজন অধ্যাপক ড. শামসুল হক। তিনিই মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এক সময়কার ছাত্র ও পরবর্তীতে সহকর্মী অধ্যাপক ইউসুফ মো. আবদুল্লাহকে দিয়ে এ কাজটি করান। পরবর্তীতে ট্রাস্ট্রির চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসির দায়িত্ব পালন করা ড. শামসুল হকও বিশ্ববিদ্যালয়টির শীর্ষপদে বেশিদিন থাকতে পারেননি। ২০১২-২০১৩ সালের দিকে তাকেও নীতিনির্ধারণী সকল কাজ থেকে অব্যাহতি নিতে হয় তাকে। বোর্ড অব ট্রাস্টিজে রাখা হয় নামমাত্র সদস্য করে।

রাজধানীর কাওরান বাজারে এই ভবনে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা

বর্তমানে অধ্যাপক ইউসুফ মো. আবদুল্লাহর পরিবারের ‘দখলে থাকা’ এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ফেরত চান প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্যোক্তারা। এ নিয়ে তারা নিম্ন আদালতে মামলাও করেছেন। চিঠি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির আচার্য ও রাষ্ট্রপতি বরাবর। এর বাইরেও শিগগিরই উচ্চ আদালতে গিয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন তারা। 

আরেক উদ্যোক্তা ও ট্রাস্টের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মো. আবু আহমেদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অধ্যাপক ড. শামসুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ শিক্ষক ছিলেন। তার ছাত্র ও পরে সহকর্মী ইউসুফ মো. আবদুল্লাহকে এখানে নিয়ে আসেন তিনি। এরপর আমাদের সবাইকে এক প্রকার জোর করে বের করে দেন। এর কয়েক বছর পর ড. শামসুল হককেও বের করে দেন তিনি। 

সূত্রের তথ্য, ২০১১ সালে অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ ট্রাস্টটি দখল করে নিজের পছন্দসই ৯ জনকে মনোনয়ন দেন। পূর্ববর্তী বোর্ডের একজন সদস্য অধ্যাপক ড. শামসুল হককে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। এর বাইরে নতুন সদস্য হয়েছিলেন অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ। বর্তমানে তিনি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন।

এছাড়াও বোর্ডে তিনি রেখেছেন স্ত্রী হালিমা সুলতানা জিনিয়া, মা দোলেনা খানম, বাবা আনসার আলী, ছেলে সাদ-আল-জোবায়ের আব্দুল্লাহ, মেয়ে লাবিবা আব্দুল্লাহ, বোন মোসাম্মদ হাবিবুন নাহার এবং বোনের ছেলে নাজমুস সাদাতকে। এর মধ্যে বর্তমানে স্ত্রী হালিমা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান। এছাড়া বাকিরা বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ২০০২ সালের ১৭ অক্টোবর একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সরকারের কাছে আবেদন করেন নর্দান ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তারা। তখন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি সংক্ষেপে আইবিএটি ট্রাস্ট নামে আবেদনের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্থাপন ও পরিচালনার অনুমতি প্রদান করে। নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ’র উপাচার্য এবং শুরুর বিওটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শামসুল হক ও বাকি ছয় সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনা শুরু করেন। পরবর্তীতে অধ্যাপক ড. শামসুল হকের হাত ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আসেন অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ। এরপর অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ এবং আইবিএটি ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শামসুল হকের যৌথ সিদ্ধান্তে বাতিল করেন শুরুর দিকের বোর্ডটি। পরে এনইউবি নামে নতুন ট্রাস্ট গঠন করে দুজন মিলে গড়ে তোলেন নতুন বোর্ড। নয় সদস্যের এ বোর্ডের স্থান পান আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহর পরিবারের ৭ সদস্য। এর মধ্যে তার মেয়ে লাবিবা আব্দুল্লাহ’র বয়স কম থাকায় কাগুজে বয়স বাড়িয়ে সদস্য করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। 

অধ্যাপক ড. শামসুল হকের হাত ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আসেন অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ। এরপর অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ এবং আইবিএটি ট্রাস্ট্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শামসুল হকের যৌথে সিদ্ধান্তে বাতিল করেন শুরুর দিকের বোর্ডটি। পরে এনইউবি নামে নতুন ট্রাস্ট গঠন করে দুজন মিলে গড়ে তোলেন নতুন বোর্ড।

নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এনইউবি) প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তারা বলছেন, কোনো ধরনের আইনের তোয়াক্কা না করেই তাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। অধ্যাপক আবু ইউসুফ নিজের পারিবারিক বোর্ড বানিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একক আধিপত্য। তাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের অর্থ স্থায়ী তহবিলে জমা না দিয়ে দুবাই-মালেশিয়াসহ কয়েকটি দেশে পাচার করেছেন বর্তমান চেয়ারম্যান। বিভিন্ন সময়ে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে তিনি নিজের মত বদলে সুবিধা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ তাদের। অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ’র বিশ্ববিদ্যালয়ের একক করায়ত্ত নেওয়ার পর বাড়তে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঋণের পরিমাণ। ট্রাস্টের অধীনে থাকা সম্পত্তি করায়ত্ত এবং দখলের পাশাপাশি পূর্ববর্তী সদস্যদের দমাতে ছিল বিভিন্ন ধরনের মামলাও। 

গত ২৯ আগস্টে এই সংবাদটি প্রথম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের আগে ট্রাস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে কথা বলতে নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এনইউবি) বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের (বিওটি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ইউসুফ মো. আবদুল্লাহকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো ধরনের সাড়া দেননি।  ঢাবির ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অফিসে একাধিক দিন গেলেও তাকে অনুপস্থিত পাওয়া যায়। পরে অধ্যাপক ড. ইউসুফ মো. আবদুল্লাহর মেইলে প্রতিবেদেন সংক্রান্ত কয়েকটি প্রশ্ন লিখে পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি। বিশ্ববিদ্যালয়টির জনসংযোগ শাখা থেকে জানানো হয়, আগের ট্রাস্টিদের কাছ থেকে ২০১১ সালে যথাযথ প্রক্রিয়ায় হস্তানান্তর করা হয়েছে। সেখানে আইনের কোনো ব্যতয় কিংবা অবৈধভাবে ট্রাস্ট দখল করার মতো কিছু হয়নি। 

তবে সংবাদটি প্রকাশের পর বোর্ড সেক্রেটারি পারভীনের মাধ্যমে একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন অধ্যাপক আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ যা আজ (৭ সেপ্টেম্বর) সংবাদটিতে যুক্ত করা হলো। তিনি বলেন, আমি সকল আইন ও নিয়ম মেনে সম্পূর্ণভাবে আইন মোতাবেক এই ট্রাস্টের দায়িত্ব নেই। পূর্ববর্তী সময়ে ট্রাস্টের নামে থাকা সকল ঋন এবং সদস্যদের দাবিকৃত সকল অর্থ পরিশোধ করেছি। এর পক্ষে সকল প্রমাণ ও দলিল আমার কাছে রয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিজস্ব অর্থায়নে জমি ক্রয় থেকে শুরু করে সকল প্রকার উন্নয়ন নিশ্চিত করে যাচ্ছি। মেডিকেল কলেজের জন্য নতুন একাডেমিক ভবন কিনেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থদন্ড দিয়ে দুটি ব্যাচের অনুমোদন নেই। বিগত সরকারের সময় মেডিকেল কলেজটি রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়। বর্তমান সময়ে একটি কুচক্রীমহল মিথ্যা বানোয়াট, বিভ্রান্তিমূলক ও ভিত্তিহীন তথ্য অপপ্রচারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করার জন্য অনৈতিক সুযোগ সন্ধান করছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়টির শুরুর গল্প
উচ্চশিক্ষায় বিদেশমুখিতা কমাতে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে দেশেই আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে ২০০২ সালে যাত্রা শুরু করে নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে করা হয় অস্থায়ী ক্যাম্পাস। এর আগে অধ্যাপক ড. শামসুল হক, লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিনসহ ৭ জন তরুণ উদ্যোক্তা এই প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে আইবিএটি ট্রাস্ট নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। পরবর্তীতে ২০০২ সালের ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্থাপন ও পরিচালনার অনুমতি প্রদান করে। নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি সুনামের সঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষা অর্জনের একটি আস্থার স্থানে পরিণত হয় বলে দাবি করেন উদ্যোক্তারা।

কাওরান বাজার থেকে বনানী স্থানান্তর হওয়ার পর এই ভবনে চলে কার্যক্রম

উদ্যোক্তাদের আরও দাবি, প্রতিষ্ঠানটি যখন বেশ খ্যাতি লাভ করে তখনই অধ্যাপক ড. শামসুল হক (সভাপতি আইবিএটি ট্রাস্ট) তার এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং পরবর্তীতে সহকর্মী অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহকে এনে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। একইসঙ্গে তাকে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য করার প্রস্তাবও করেন।

অধ্যাপক ড. শামসুল হকের একক সিদ্ধান্ত ও ট্রাস্ট দখল শুরু
২০০৮ সালে আইবিএটি ট্রাস্টের ১২তম বোর্ড সভায় ড. শামসুল হকসহ প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে দুজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক নিয়োগ দেন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০১১ সালে ড. শামসুল হক ভিসি হিসেবে তার একক সিদ্ধান্তে তাদেরকে ওই পদ থেকে চাকুরিচ্যুত করেন। ট্রাস্টি বোর্ডের সিদ্ধান্ত একমাত্র  ট্রাস্টি বোর্ডই পরিবর্তন করতে পারেন।  একক সিদ্ধান্তে এটি পরিবর্তন করা আইনসঙ্গত নয়। 

ওই বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কার্যালয় কারওয়ান বাজার থেকে বনানীতে স্থানান্তর করেন। পরবর্তীতে উদ্যোক্তাদের অগোচরে অধ্যাপক ড. শামসুল হক এবং অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ তাঁর মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই, বোন মিলে নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এনইউবি) ট্রাস্ট গঠন করে। পরে মূল উদ্যোক্তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে বাধা দেন এবং নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের প্রকৃত উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতাদের বাদ দিয়ে নতুন নামে এনইউবিটি ট্রাস্টি গঠন করেন। সূত্রের তথ্য, নতুন ওই ট্রাস্টিতে আগের ৭ ট্রাস্টির মধ্যে বাদ পড়েন ছয় জন। নতুন ট্রাস্ট গঠন হয় ৯ সদস্যের, সেখানে আগের ট্রাস্ট থেকে ছিলেন শুধুমাত্র ড. শামসুল হক।

উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, এ ঘটনার পর তাদেরকে বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে নানারকম ভয়-ভীতি ও মামলার ভয় দেখান, স্বাক্ষর জাল করেন ও তাদেরকে প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে দূরে রাখেন। 

তিন কারণে আইবিএটি ট্রাস্টে অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ
আইবিএটি ট্রাস্টের অধীনে নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশসহ একাধিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ছিল। ২০১০ সালের দিকে এসে ট্রাস্টের অন্যতম উদ্যোক্তা মো. আবু বকর সিদ্দিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। জানা যায়, ট্রাস্টের অধীনে  এসব অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে সব ধরনের আর্থিক কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের দায়িত্বে ছিলেন মো. আবু বকর সিদ্দিক। সে সময় ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকা, অন্যদিকে তার অসুস্থতা বেড়ে যাওয়া এবং পরবর্তীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ হলে স্থায়ী ক্যাম্পাসে ফেরার বাধ্যবাধকতা— এই তিন কারণে আইবিএটি ট্রাস্টে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেন তারা। আর এই সময়েই ট্রাস্টে নিজের স্থান তৈরি করেন ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ। পরবর্তীতে ২০১১ সালে মো. আবু বকর সিদ্দিক মারা গেলে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন আবু ইউসুফ। প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি প্রাসাদ নির্মাণ লিমিটেডের মালিক। তাদের এই সংকটে অধ্যাপক ড. শামসুল হক তাকে (ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ) আইবিএটি ট্রাস্টে নিয়ে আসেন।

সমঝোতা স্মারক সাক্ষর ও ট্রাস্টের অধীনে সকল প্রতিষ্ঠান দখল!
প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, ২০১১ সালের ২৮ মার্চ একটি সমঝোতা স্মারক সাক্ষরের মাধ্যমে আইবিএটি ট্রাস্টের সদস্য হতে গিয়ে এই ট্রাস্টের অধীনে সকল প্রতিষ্ঠান দখল নিয়েছিলেন অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ। জানা গেছে, ওই সমঝোতা স্মারকে উল্লেখ ছিল ট্রাস্টের মূল প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় ও অঙ্গ প্রতিষ্ঠান নর্দান মেডিকেল কলেজ পরিচালনার জন্য আইন অনুযায়ী নতুন সদস্য অর্ন্তভূক্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সে অনুযায়ী, আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ তার প্রতিষ্ঠান প্রাসাদ নির্মাণ লিমিটেডের মাধ্যমে ট্রাস্টের সদস্য হওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। ওই আগ্রহের কারণেই এই সমঝোতা স্মারক সাক্ষর হয়েছিল।

রাজধানী ঢাকার এয়ারপোর্ট সংলগ্ন আশকোনায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলছে কার্যক্রম

প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তাদের মতে, সেই সমঝোতা স্মারকে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, বর্তমান ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠানগুলো তৎকালীন ঋণ পরিশোধ এবং ভবিষ্যতে পরিচালনার জন্য কোনো ঋণ বা ফান্ড প্রয়োজন হলে সেই দায়িত্ব নেবেন ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ। সেখানে একটি নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ কন্ট্রিবিউশেনের কথাও উল্লেখ করা হয়। সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়নে সেটি ৩০ দিনের মধ্যে বাস্তাবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু স্মারকের কোনো কিছুই ইউসুফ আবদুল্লাহ বাস্তবায়ন করেনি। ফলে সেটি অকার্যকর হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে আরেকটি সমঝোতা স্মারক জাল করে মূল উদ্যোক্তাদের বের করে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নেন তিনি। 

সমঝোতা স্মারকে কী ছিল?
২০১১ সালের ২৮ মার্চ প্রতিষ্ঠাকালীন ৭ জন উদ্যোক্তার সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছিল অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহসহ তার পরিবারের ৭ সদস্যদের। স্মারকে উল্লেখ ছিল, বর্তমান ট্রাস্টিরা ট্রাস্টের কার্যক্রম পরিচালনা করার সময় ঋণের দায়ভার বহন করে, যা তারা নিষ্পত্তি করতে পারছেন না। এ অবস্থায় তারা ট্রাস্টের ট্রাস্টি হতে আগ্রহী ব্যক্তিদের ট্রাস্টে অধিগ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে যাতে এই ঋণের দায় নিষ্পত্তি এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পরিচালনা করতে পারে।

সূত্রের উভয় পক্ষের সমঝোতা স্মারক সাক্ষরের দিন ৫ কোটি টাকা দিয়েছিলেন অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে ৯০ দিনের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করার কথা থাকলেও তা করেননি তিনি।

এতে আরও উল্লেখ করা হয়, বর্তমান ট্রাস্টিদের এমন ইচ্ছার কথা জানতে পেরে প্রস্তাবিত ট্রাস্টিরাও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সংস্থার সাথে ট্রাস্টের দায়-দায়িত্ব নিষ্পত্তির জন্য অবদান রাখতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এতে প্রস্তাবিত ট্রাস্টিরা একটি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা ট্রাস্টে প্রদানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং এর ফলে এই সমঝোতা স্মারক সাক্ষর হয়। জানা গেছে, এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের দিন ৫ কোটি টাকা দিয়েছিলেন অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে ৯০ দিনের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। 

জোর করে পদত্যাগপত্র ও অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর
প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের তৎকালীন এক প্রভাবশালী নেতা ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার প্রভাব দেখিয়ে তাদের নানা ভয়ভীতি দেখাতেন আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ। কখনও তাদের বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টতা আবার কখনও অবৈধ ক্যাম্পাসে রয়েছে বলে এই ভয়ভীতি দেখাতেন তিনি।

তাদের অভিযোগ, এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ২৭ জুলাই প্রতিষ্ঠাকালীন ৬ জন উদ্যোক্তার কাছ থেকে জোর করে পদত্যাগ পত্রে সাক্ষর নেন অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ। পদত্যাগ পত্রের এসব কপি এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নামায় স্বাক্ষর ও টিপ সই-ও নেওয়া হয়। 

বর্তমানে ট্রাস্টের অধীনে সম্পদের পরিমাণ কত?
প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তারা জানিয়েছে, বর্তমানে আইবিএটি ট্রাস্টের অধীনে প্রতিষ্ঠানসমূহে ২ হাজার কোটি টাকার উপরে স্থায়ী সম্পদ আছে। এর মধ্যে ধানমন্ডিতে বিশ কাঠার উপর দুটি বেজমেন্ডসহ আটতলা ভবন, মিরপুর ১০ নম্বরে চার বিঘা জমির উপর ১৫ তলা মার্কেট নির্মাণাধীন, কারওয়ান বাজার ৭টি ফ্লোর, নিউ মার্কেট গ্লোব শপিংয়ে ৪টি ফ্লোর, আসকোনায় পাঁচ বিঘার উপর ১০ তলা ভবন নির্মাণাধীন), রাজশাহী, বোয়ালীয়া উপজেলা, কাজলা মৌজায় ৯৫৬ ও ৯৫৭ দাগে ১৮ কাঠা জমি ।

উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, তাদের সাক্ষর জাল, জোরপূর্বক দখল এবং ট্রাস্টের নাম পরিবর্তন করে এর সম্পদ নিজেদের নামে লিখে নিয়ে বছরে ৫০ থেকে ৬০ কোটি লাভ করেছে অধ্যাপক ইউসুফ। বর্তমানে ব্যাংকের দেনা পরিশোধ না করায় এবং ব্যাংক গ্যারান্টি তাদের নামে থাকায় অর্থঋণ আদালতে চারটি মামলা চলমান, প্রায়ই তাদের মামলার হাজিরা দিতে হয়। এছাড়াও আরও মামলা প্রক্রিয়াধীন; যা আর্থিক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছেন এবং বিষয়টি অপমান লাগে— জানান ভুক্তভোগী উদ্যোক্তারা।

জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ
২০২২ সালের শুরুতে ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও জাল দলিলে জমি লিখে নেওয়ার অভিযোগে নর্দান ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের এই চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই)।

পিবিআই সে সময় জানিয়েছিল, খিলক্ষেত থানার একটি মামলায় মো. আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আশিয়ান ল্যান্ডস ডেভেলপমেন্টের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম ভুঁইয়ার করা মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হন। মামলায় তিনি ছাড়াও আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতি করে জমি দখল, প্রতারণা ও হুমকির অভিযোগ আনা হয়।

এজাহারে বলা হয়েছিল, নর্দান ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস করতে রাজধানীর দক্ষিণখান মৌজায় আশিয়ান ল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট থেকে পাঁচ বিঘা জায়গা কেনেন। ওই জমির ৫০ কোটি টাকা মূল্যের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করলেও বাকি টাকা না দিয়েই ভবন নির্মাণ শুরু করেন। তার কাছ থেকে টাকা চাইলে বিভিন্ন সময়ে তা পরিশোধের আশ্বাস দেন। কিন্তু সম্প্রতি টাকা চাইতে গেলে তিনি দাবি করেন জায়গাটি ৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় কিনে নিয়েছেন তিনি। এ সংক্রান্ত জাল স্টাম্পের দলিলও দেখানো হয়। 

চলতি মাসের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দখলকৃত ট্রাস্ট্রি ফেরত পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। সেই বিশ্বাসেই নর্দানের দখলকৃত এই বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজও ফেরত চান প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা। এ নিয়ে তারা মামলাও করেছেন। চিঠি দিয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ফিরতে চান প্রকৃত উদ্যোক্তারা 
প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা ছিলেন ৭ জন। এর মধ্যে অধ্যাপক ড. শামসুল হক বর্তমানে শয্যশয়ী। তিনি নামমাত্র বিওটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। বাকি ৬ জনের মধ্যে মো. আবু বকর সিদ্দিক মারা গেছে। বাকি ৫ জনের মধ্যে আয়েশা আক্তার বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। তাছাড়া বাকি ৪ জন হলেন মো. আবু আহমেদ, মো. লুৎফর রহমান, বোরহান উদ্দিন এবং মো. রেজাউল করিম।

চলতি মাসের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দখলকৃত ট্রাস্ট ফেরত পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। সেই বিশ্বাসেই নর্দানের দখলকৃত এই বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ফেরত চান প্রতিষ্ঠানটির এসব উদ্যোক্তারা। এ নিয়ে তারা মামলাও করেছেন। চিঠি দিয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে। 

প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা বোরহান উদ্দিন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অধ্যাপক ড. শামসুল হককে নানা প্ররোচনা দেখিয়ে ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। পরবর্তীতে তিনি শুধু আমাদের বের করে দেননি, বের করেছেন অধ্যাপক ড. শামসুল হককেও। এরপর থেকে তার পরিবার পুরো বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নেয়। আমরা দখলকৃত এই বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ফেরত চাই। এজন্য মামলাও চলমান এবং একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় আচার্যসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে সদয় দৃষ্টি কামনা করছি। আগের ট্রাস্টি ফিরে পেতে শিগগিরই বাড়তি আইনগত পদক্ষেপ নেবেন বলেও তিনি জানান। 

আরেক উদ্যোক্তা ও ট্রাস্টের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মো. আবু আহমেদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অধ্যাপক ড. শামসুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ শিক্ষক ছিলেন। তার ছাত্র ও পরে সহকর্মী ইউসুফ মো. আবদুল্লাহকে এখানে নিয়ে আসেন তিনি। এরপর আমাদের সবাইকে এক প্রকার জোর করে বের করে দেন। এর কয়েক বছর পর ড. শামসুল হককেও বের করে দেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগের দাপট দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি জবর দখল করেছিলেন সে সময়। তাকে শিক্ষক বলা যায় না। দুর্বৃত্তায়ন করে তিনি এটি দখল করেছেন। সরকারের পট-পরিবর্তনের পর অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম দুর্বৃত্তায়নকারীরা পলায়ন করছে। আগের ট্রাস্টিরা ফিরে আসছে, আমরাও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত পেতে চাই।’