1
কোটা আন্দোলন: মুক্তি কি সত্যিই মিলেছে?
- মতিউর রহমান
- ৩০ নভেম্বর -০০০১, ০০:০০
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানিয়েছেন, ‘সরকার চাইলে আবার কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে পারবে। সেক্ষেত্রে এখনকার প্রক্রিয়াগুলোই অনুসরণ করতে হবে।’ মূলত এ বিষয়টি নিয়ে দ্বিধায় পড়েছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও আন্দোলনরত হাজারো চাকরিপ্রার্থী। সত্যিই কোটা পদ্ধতি ফিরে আসবে? দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস’র অনুসন্ধান—
বাতিল-বহালের ডামাডোল চলছে কোটা পদ্ধতিতে। পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্রথমে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন ও পরে প্রজ্ঞাপন জারি হলেও বিষয়টি নিয়ে ধন্ধে পড়েছেন হাজারো চাকরিপ্রার্থী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে মন্তব্য, পাল্টা মন্তব্য। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য— বাতিলের মাধ্যমে কোটা পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র চলছে; যা নিয়েই তাদের আপত্তি। তাছাড়া কোটা বাতিল হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ও উপজাতিদের বিশেষ নিয়োগ হবে কিনা—সে বিষয়েও সন্দিহান তারা। অন্যদিকে বাতিলের প্রতিবাদে ‘কোটা চাই’ শিরোনামে রাজধানীর শাহবাগে দ্বিতীয় দিনের মত আন্দোলন করেছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। প্রস্তুতি নিচ্ছে আদালতে রিট দায়েরের। সবমিলিয়ে বিষয়টি নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায়।
সূত্র বলছে, আজ ৪ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারির আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬% কোটা বহাল ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৩০%, নারী ১০%, জেলা ১০%, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ৫% এবং প্রতিবন্ধী ১%। বাকি ৪৪% ছিল মেধাবীদের জন্য। তবে পরিপত্র প্রকাশ হওয়ায় নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী) কোটা ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেল।
জানা যায়, বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির প্রচলন বেশ আগে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও এই ভূখণ্ডে কোটা পদ্ধতির প্রচলন ছিল। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সবমিলিয়ে ৪০% কোটা বরাদ্দ ছিল। আর মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম চাকরিতে কোটা পদ্ধতির ব্যবস্থা করা হয়; যা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে সংশোধন হয়। তবে বাতিল হওয়ার সিদ্ধান্ত এই প্রথম। সম্ভবত এ কারণেই বিষয়টি নিয়ে নানা সন্দেহ-সংশয় তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট সবার মাঝে। যাতে নতুন করে মদদ যুগিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের বক্তব্য। তিনি জানিয়েছেন, সরকার চাইলে আবার কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে পারবে। সেক্ষেত্রে এখনকার প্রক্রিয়াগুলোই অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ সচিব কমিটিকে পুনরায় পর্যালোচনার দায়িত্ব দিতে হবে, তাদের সুপারিশ মন্ত্রিসভা কমিটিতে উত্থাপন এবং অনুমোদন হতে হবে। এরপর পুনরায় প্রজ্ঞাপন জারি করে কোটা ব্যবস্থা বহাল করতে হবে। অর্থাৎ পুরো বিষয়টিই নির্ভর করছে সরকারের ইচ্ছার ওপর। সরকার চাইলে এই কমিটি পুনর্বিন্যাস করতে পারে।
আর সাবেক সচিব আকবর আলি খান বলছেন, ভবিষ্যতে যদি দেখা যায় বা সরকার মনে করে যে, কোন কোটার দরকার, তাহলে সরকার যেকোনো সময় সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কোন কিছুই চিরন্তন নয়, সরকার পর্যালোচনা করে যেকোনো সময় কোটা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তিনি আরো জানান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ কারো কারো এখনো কোটার বিষয়ে বক্তব্য আছে। কোটার অন্যান্য বিকল্পও আছে। যদি সরকার মনে করে যে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বা প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটার প্রয়োজন আছে, তখন সরকার যেকোনো সময় সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মূলত এসব বিষয় নিয়িই চিন্তিত আন্দোলনরত হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী।
কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন দ্যা ডেইলি ক্যম্পাসকে জানান ‘পরবর্তীতে কোটা পুনঃপ্রবর্তন নিয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে। বিভিন্ন চাকরিতে বিশেষ নিয়োগ নিয়েও আপত্তি জানান তিনি।’ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বক্তব্য বিষয়ে মামুন বলেন, সরকার চাইছে- কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকার মুক্তিযোদ্ধা ও উপজাতিদের বিশেষভাবে নিয়োগ দিতে চাইছে। কিন্তু সেটা আমরা মানিনি। এ বিষয়ে আগেই আমাদেরকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। তার ভাষ্য, যদি বিশেষভাবেই তাদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে মূল নিয়োগ পরীক্ষা থেকে কোটা বাদ দেয়ার কোনো অর্থই হয় না।
মামুন বলেন, আমরা চাই ৫ দফার আলোকে কোটার একটি যৌক্তি সংস্কার। যে কয় ধরনের মানুষের জন্য বর্তমানে কোটা বরাদ্দ রয়েছে তাদের সবার জন্যই কিছু সংখ্যক আসন থাকুক। তবে সেটা বর্তমান মোট ৫৬ শতাংশের কমিয়ে ১০, ১৫ বা ২০ শতাংশ করা যেতে পারে। আমরা কখনো কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণ বাতিল চাইনি, এখনও চাইনা।
এদিকে কোটা পদ্ধতি বাতিলের প্রতিবাদে বুধবার রাত থেকেই শাহবাগে অবস্থান নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা; যা বৃহস্পতিবারও চলমান ছিল। সংশ্লিষ্টদের চাওয়া, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য সুরক্ষা আইন, রাজাকারের সন্তানদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ না দেওয়া ও তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। দাবি আদায়ে আদালতে রিট করার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসান জানান, ‘পরিপত্র জারি না হওয়া পর্যন্ত আইনী লড়াইয়ে যাওয়া যাচ্ছিল না। এখন যেহেতু পরিপত্র জারির প্রস্তুতি চলছে এবং মন্ত্রিসভায় কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। তাই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা কোটা বাতিলকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করবে।’
থাকছেই কোটা: বিবিসি’র খবরে বলা হয়, প্রতিবন্ধীদের নিয়োগের মতো কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন রয়েছে। কোটা বাতিল হলেও এসব ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগের সুবিধা থাকছে। যেমন পিএসসি ছাড়া স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, কর্পোরেশনে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে নিজেরা নিয়োগ দিয়ে থাকে, তাদের বিধিমালা অনুসারে কোটার বিধান থাকলে, সেটি তারা অনুসরণ করতে পারবে। সেসব নিয়োগ এই কোটার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বলে জানিয়েছেন সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
সরকারি কর্ম কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে যেসব নিয়োগে কোটার শর্তটি উল্লেখ করা হয়নি বা নিয়োগ শেষের দিকে রয়েছে, সেখানে নতুন কোটানীতি প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু যেসব নিয়োগ বিজ্ঞাপনে এই শর্তটি উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে নতুন কোটা নীতি অনুসারে নিয়োগ হবে।
তবে এত কিছুর মধ্যেও শিক্ষার্থীদের জন্য আশার খবর হলো— শিঘ্রই অনুষ্ঠেয় ৪০তম বিসিএসে কোটা পদ্ধতি থাকছে না। বৃহস্পতিবার এক সাক্ষাৎকারে সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক জানিয়েছেন, কোটা বিষয়ে সরকারের সবশেষ গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪০তম বিসিএসে নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। যেহেতু কোটা বাতিল হয়েছে, তাই এই বিসিএস থেকেই মেধার ভিত্তিতে ক্যাডার নিয়োগ হবে। এছাড়া কয়েকটি নন ক্যাডার নিয়োগের ক্ষেত্রেও কোটার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল; সেটিও কার্যকর হবে।
তথ্যমতে, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে চাকরি প্রার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে গত ২ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। প্রাথমিকভাবে ১৫ কার্যাদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও পরে আরো ৯০ কার্যদিবস সময় পায় এ কমিটি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সেটির ভিত্তিতেই গত বুধবার মন্ত্রিসভায় আলোচনা-পর্যালোচনা করে অনুমোদন ও বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।