সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়লেও মৌলিক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমছে বেসরকারিতে

শিক্ষার্থী ভর্তি
বিশ্ববিদ্যালয়

দেশের ৫৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বিপরীত চিত্র বেসরকারিতে। বর্তমানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোয় পড়ছেন ৩৮ হাজার ৩৬ জন শিক্ষার্থী এবং যা মোট সংখ্যার ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সে হিসেবে বিগত প্রায় পাঁচ বছরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বেড়েছে ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। বিপরীতে দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয়গুলোতে মৌলিক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী রয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৮২৩ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ২ শতাংশ।

দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। কমিশন তাদের এসব প্রতিবেদনে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধিকে ইতিবাচক মনে করলেই বিপরীতে মৌলিক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাওয়াকে অদূর বাংলাদেশে বিনির্মানে বড় বাঁধা হিসেবে।

ইউজিসি বলছে, বর্তমানে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে চাহিদাভিত্তিক যুগোপযোগী বিষয় ও পাঠ্যক্রম প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে

এর আগে ২০১৯ সালে দেশের ৪৩ সরকারি উচ্চশিক্ষালয়ে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ হাজার ৮৮৮ জন। শতকরা হিসেবে যা তখন দেশের মোট শিক্ষার্থীদের ১ দশমিক ৩১ শতাংশ মাত্র। তবে একই সময়ে ইউজিসির ওই প্রতিবেদনে দেশের বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষালয়গুলোয় ভৌত বিজ্ঞানের বিষয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। শুধু বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে থাকা শিক্ষার্থীদের তথ্য জানিয়েছে দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক এ সংস্থা।

ugc

ইউজিসি বলছে, বর্তমানে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে চাহিদাভিত্তিক যুগোপযোগী বিষয় ও পাঠ্যক্রম প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে; বিশেষ করে ল্যাবরেটরি সায়েন্স, ইলেক্ট্রনিকস এন্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, আইসিটি, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, পারফর্মিং আর্টস ইত্যাদি।

এপিইউবি বলছে, দেশের উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান বেড়েছে। সেজন্য এখাতে যৌক্তিক আইন-নীতিমালা সুস্পষ্ট থাকা উচিত। সেই সাথে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুযোগ-সুবিধা বাড়লে মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে আরও বেশি শিক্ষার্থী আসবে।

কমিশন আশা করছে, এর ফলে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি সহায়ক হবে বিজ্ঞানমনস্ক জ্ঞানভিত্তিক ডিগ্রি, জাতীয় উন্নয়ন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে। তবে তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বাড়লেও বিজ্ঞানের মৌল বিষয়সমূহে ছাত্র সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ায় দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ব্যাহত হতে পারে বলেও শঙ্কিত কমিশন।

আরও পড়ুন: ৩০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে ইউজিসির সতর্কতা

দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি (এপিইউবি) মনে করে এখনও এখাতে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সংশ্লিষ্টদের একসাথে কাজ করতে হবে বলেও মনে করে সংগঠনটি। এপিইউবি বলছে, দেশের উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান বেড়েছে। সেজন্য এখাতে যৌক্তিক আইন-নীতিমালা সুস্পষ্ট থাকা উচিত। সেই সাথে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুযোগ-সুবিধা বাড়লে মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে আরও বেশি শিক্ষার্থী আসবে।

২০২২ সালে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালু থাকা ১০০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী রয়েছে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদে। বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয়গুলোর ৪৩ দশমিক ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই এ সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা অনুষদের শিক্ষার্থী।

ইউজিসির সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালু থাকা ১০০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী রয়েছে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদে। বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয়গুলোর ৪৩ দশমিক ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই এ সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা অনুষদের শিক্ষার্থী।

এরপর ব্যবসায় শিক্ষায় ২২, কলা ও মানবিকে ১১ দশমিক ৭,  আইনে ৬ দশমিক ৯, সামাজিক বিজ্ঞানে ৩ দশমিক ৪৯, ফার্মেসিতে ৩ দশমিক ২২, টেক্সটাইল ও ফ্যাশনে ৩ দশমিক ৭, বিজ্ঞানে ২ শতাংশ, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং জনস্বাস্থ্যে ১ দশমিক ৭৬, জীববিজ্ঞানে ১ দশমিক ৪০, কৃষিতে শূন্য দশমিক ৫০, মেডিসিনে দশমিক ৩০, ভেটেরিনারি ও এনিমেল সায়েন্সে দশমিক ৫০ এবং অন্যান্য বিভাগ ও অনুষদে রয়েছে ১ দশমিক ১০ শতাংশ বিদ্যার্থী।

আরও পড়ুন: ৫৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পকেটে বার্ষিক উদ্বৃত্ত ১,২৫০ কোটি টাকা

প্রচলিত মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণেই আমরা বিজ্ঞান শিক্ষাকে হাতে-কলমে শেখাতে পারছি না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বর্তমানে প্রচলিত ব্যবহারিক পরিক্ষা অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা।

অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমানের মতে, ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে প্রথমত, আমাদের শিক্ষকরাই আগ্রহী না শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান তত্ত্বের পাশাপাশি তাদের হাতে-কলমে শেখানোর বিষয়ে। দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যেহেতু তথ্য প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ সহজে চাকরির সুযোগ করে দিচ্ছে, সেহেতু মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়ে বিনিয়োগ অনেকটাই অপচয়।

APUB

অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা প্রচলিত শিক্ষায় প্রয়োজনভিত্তিক দক্ষ জনবল তৈরি করতে পারছি না। আমাদের মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ানো উচিত। আমাদের দক্ষ জনবল না থাকলে তো আপনি কাজ করতে পারবেন না।

তিনি দেশের বেসরকারি খাতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমাদের দক্ষ জনবলের অভাবের সুযোগ নিয়ে পার্শ্ববর্তী ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ আমাদের দেশ থেকে প্রায় ৫-৬ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। সেজন্য এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন শিক্ষা এবং দক্ষতার সম্মিলন ঘটাতে হবে। সেজন্য দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা বিশেষকরে বিজ্ঞান শিক্ষায় হাতেকলমে শিখিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে বলেও জানান ড. কাজী খলীকুজ্জমান।

ড. কাজী খলীকুজ্জমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা প্রচলিত শিক্ষায় প্রয়োজনভিত্তিক দক্ষ জনবল তৈরি করতে পারছি না। আমাদের মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ানো উচিত। আমাদের দক্ষ জনবল না থাকলে তো আপনি কাজ করতে পারবেন না।

আর এবারের প্রতিবেদনে গবেষণাসহ দেশের উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে বেশকিছু সুপারিশ জানানো হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন। কমিশনের এই সদস্য বলছেন, প্রতিবেদনের সুপারিশ এবং সংশ্লিষ্ট বিধান-অনুসঙ্গ মেনে চললে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আরও ভালো অবস্থান করতে পারবে।