রম্য

লাইক ইউ ‘জি’!

©

অম্নাকুসুম চক্রবর্তী: ফেসবুক-মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই তোমার মুখটি দেখিতে চাহি না আর। সত্যিই তো! দুনিয়াকে যদি কাছাকাছি কেউ এনে দিয়ে থাকেন, তিনি মার্ক জুকারবার্গ ছাড়া আর কে! আর ফেসবুককে আরও কাছাকাছি, আমার আপনার সঙ্গে লেপ্টে দেওয়ার জন্য সব ‘জি’-দের মধ্যে মারপিট। টু জি, থ্রি জি, ফোর জি-  জানি না আরও কত ‘জি’ হবে। ‘জি’-র বিজ্ঞাপনগুলোতে দেখি বন্ধুদের মধ্যে আড্ডায় ডাউনলোডের প্রতিযোগিতা চলে। ফেসবুকে লোড করা একটা গোটা ভিডিও মোবাইলে যে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি ডাউনলোড করে ‘ইয়ে, ইউপ্পি’ বলে উঠতে পারবে, খেলাতে তারই জিৎ। ওই বন্ধুদের কেউই নিজেদের মধ্যে বিশেষ কথাবার্তা বলে না। সবাই নিজের নিজের মতো করে ডাউনলোডে মত্ত থাকে। আড্ডার ধরনও হয়তো বদলাচ্ছে এভাবেই। সৌজন্য ফেসবুক।
হাল আমলে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সঙ্গে যেটা একই বন্ধনীতে উল্লেখ করা যেতে পারে, তা হলো নেটওয়ার্ক। এ দেশে রেশন কার্ড যত, তার থেকেও হয়তো অনেক বেশি মোবাইল কানেকশন। আগে মোবাইল টাওয়ার, তার পরে পাকস্থলীতে পাওয়ার। মানে ভাত-রুটি আর কী। আপনার মোবাইলে হোয়াটস অ্যাপ বা ফেসবুক যদি না থাকে তাহলে আপনি বড়োই সেকেলে। মোবাইলটা স্মার্ট; কিন্তু তাতে ফেসবুক নেই? যাঃ, এ হতে পারে না-কি! এখানে একটা প্রশ্ন করার শখ হয়। যোগাযোগের একটা মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো তর্ক হতে পারে না। কিন্তু এই এত বেশি যোগাযোগের উপায় এবং হাজারো প্ল্যাটফর্ম মানুষের মধ্যে ‘দূরত্ব’টা সত্যিই কমাচ্ছে কি? দূরকে করেছে নিকট বন্ধু; কিন্তু নিকটকে দূর নয় তো?
কোনো বন্ধু বা পরিচিত মানুষ যে নতুন ক্যামেরাটা কিনেছে বা কোনো রেস্তোরাঁর কোনো পদটা খেয়ে চারবার ‘ওয়াও’ বলেছে সেগুলো জানতে না চাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আপনার আছে। কিন্তু উপায় নেই। প্রতি দু-সেকেন্ড অন্তর টিংটিং করে মোবাইল জানিয়ে দেবে আপনার প্রতিটি ফ্রেন্ডের গতিবিধি। ধরুন, বেশ কিছুকাল পরে কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার। সে মোবাইল অন্তঃপ্রাণ। ২৪ ঘণ্টা মুঠোফোনে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ নিয়ে তার গর্বিত হালচাল। আর আপনার মোবাইলটা সেকেলে। তাতে ইন্টারনেট নেই। দেখা হয়েছে হয়তো শপিংমলে। সেখানে দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হবে অনেকটা এরকম।
প্রথম বন্ধু : কীরে ভাই, এতদিন কোথায় ছিলি?
দ্বিতীয় বন্ধু : আমি কদিন একটু বাইরে ছিলাম রে। অফিসের কাজে শিলিগুড়ি যেতে হয়েছিল।
প্রথম বন্ধু : তাই না-কি। এফবিতে কোনো আপডেট দিসনি তো।
দ্বিতীয় বন্ধু : না রে, সেটা আর দেওয়া হয়নি। কেমন আছিস?
প্রথম বন্ধু : আপডেট করলাম তো স্ট্যাটাসটা। বিন্দাস। গত মাসে বিয়ে করেছি। তুই তো এলিই না।
দ্বিতীয় বন্ধু : দারুণ খবর তো! আমাকে কিছু জানাসও নি রে!
প্রথম বন্ধু : ডোন্ট জোক। তোকে পিং করেছিলাম এফবিতে। কোনো উত্তরই তো এলো না।
দ্বিতীয় বন্ধু : আমি তো ভেবেছিলাম একটা চিঠি পাব অ্যাট লিস্ট।
প্রথম বন্ধু : চিঠি! তুই তো পুরো ওল্ড মংক রে! বুড়ো ভাম একটা। ফ্রেন্ডস সার্কেলে কেউ চিঠি পাঠায় না-কি আজকাল? যাক গে, বাদ দে। হাইক কেমন হলো বল?
দ্বিতীয় বন্ধু : আর বলিস না ভাই। সারাটা বছর ঘাড় গুঁজে কাজ করেও সেই চার পার্সেন্ট।
প্রথম বন্ধু : (দশ সেকেন্ড খিক খি করে হেসে) ওরে বুদ্ধু। ইনক্রিমেন্ট নয় রে পাগলা। আমি বলছি হাইক ম্যাসেঞ্জারের কথা। হোয়াটস অ্যাপের মতো। দেখিস নি?
দ্বিতীয় বন্ধু : না রে। আমার ফোনে তো ইন্টারনেট নেই।
প্রথম বন্ধু : (বিষম খেয়ে) নেট নেই! আর ইউ সিরিয়াস? তুই বেঁচে আছিস কী করে?
দ্বিতীয় বন্ধু : দিব্যি আছি তো। একদম ফার্স্ট ক্লাস।
প্রথম বন্ধু : গুরু, তোর সঙ্গে একটা ছবি নিই দাঁড়া। সেলফি। কী ক্যাপশন দেব জানিস? ফোর জি উইথ নো জি। প্রচুর লাইক পড়বে।
এভাবে কথাবার্তা এগোতে থাকে। লোকে একবার দেখে, বারবার দেখে, দেখে আপনার মুখ। মোবাইল নেট না, মোটে ভালো কাজ না।
আজকের ফেসবুক জমানায় সবাই শক্তি চাটুজ্জে, সবাই রঘু রাই, সবাই অর্ণব গোস্বামী। ওয়ালে ছবি দেওয়ার জন্য, নিজের ওয়ালেই আলো ছড়ানোর জন্য কত এসএলআর ক্যামেরা আর জুম লেন্সের বিক্রি হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের দেশে নেই। হয়তো বাড়ির দেয়ালে একটি পিঁপড়ে চলেছে। থার্টি এক্স জুম দিয়ে সেই পিঁপড়ের ছবি তোলা হলো। এমন ছবি যাতে পিঁপড়েটির শরীরে কটি রোঁয়া আছে আর কোন পায়ে কটা তিল আছে গুনে ফেলা যায়। ফেসবুকের ওয়ালে ওই ছবি পোস্ট করা হলো। আপনার ফোটোগ্রাফার কাম কবি বন্ধু ছবিটির ক্যাপশন দিলেন, ‘এভাবে চলতে চলতে মিশে যাব দিক্চক্রবালে, যেখানে দিক্শূন্যপুর কান পেতে আছে অফুরান।’ আপনি মানেটা কিছুই বুঝলেন না। কিন্তু দেখলেন, চোখের পলকটুকু ফেলার আগেই ওই ছবিতে পড়ে গিয়েছে ২১টি লাইক। কমেন্টের পর কমেন্ট। ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকরিলোডেড’ অথবা ‘এই চলাই তো জীবন’ এমন আরও নানারকম। ডোবায় কচুরিপানার মতো এই লাইকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আপনাকেও বাধ্য হয়ে লাইক করতে হবে, কারণ সেটি না করলে বন্ধুটি আশাহত হবে। দেখা হলে দু-কথা শুনিয়েও দিতে পারে।
এমন একজনের কথা জানি, যার লাইক করার হাতটি বরাবরই উদার। যেটাই দেখেন, লাইক করেন। সম্প্রতি উনি কোনো এক ফ্রেন্ডের পোস্টে ‘বাবা চলে গেলেন আজ সকালে’ দেখেও সেটাতে লাইক মেরে দেন।
নেটের ফাঁদ পাতা ভুবনে। কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে! আমার একজন বন্ধু ছিল। নাগরিক কোহাহল ছিল ওর কাছে কুইনাইন। আর ইনটারনেটে বন্ধুত্ব-  সে একটা ঘৃণ্য জিনিস। কবিতা লিখত। কবিতা পড়ত। আর বলত, ‘যে বন্ধুত্বে উষ্ণতার আঁচ নেই, সেই বন্ধুতাকে পদাঘাত করি আমি।’ ফেসবুক সম্পর্কে বলেছিল, ‘আমি আকাশের পাখি। ধরা দেব কেন হে এই বাইনারি খাঁচায়? ইনটারনেট-অর্কুট-ফেসবুক-নেটভরা মোবাইল আসলে কী জানিস। এটা হলো এমন একটা মাথা, যেটার অনেকগুলো টিকি। আর এই টিকিগুলো ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে। বিশে^র যে কোনো লোক ইচ্ছে হলেই টিকিগুলো ধরে টান মারতে পারে। আর কোনো একটা টিকিতে টান পড়লে মাথাটাও সেদিকে হেলিয়ে দিতে হবে। আমি এত সহজলভ্য নই। আমার প্রাইভেসি আমার অহঙ্কার, আমার অলঙ্কার।’ পরিস্থিতির চাপ অবশ্য অনেক স্লোগানকে ফিশফাশ করে দেয়। বাংলা সাহিত্য নিয়ে এমএ করেও কাজ করতে বাধ্য হলো একটা ওয়াটার পিউরিফায়ার কোম্পানিতে। লোকের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে জলের মেশিন বেচতো। হ্যান্ড ওয়াশের বিজ্ঞাপনের মতো খালি চোখেও জীবাণু দেখতে এবং দেখাতে বাধ্য হয়েছিল হয়তো। ওর বস একদিন বললেন, ‘কোম্পানির একটা ফেসবুক পেজ হচ্ছে। ওখানে মেশিনের আপগ্রেডেড মডেলের অ্যাডভার্টাইজমেন্টটা দেওয়া হয়েছে। আমাদের সবাইকে ওটা লাইক করতে হবে। শেয়ারও করতে হবে। এভাবেই পোটেনশিয়াল কাস্টমারের বেসটা বাড়বে।’ বন্ধু বলেছিল, ‘আমি তো ফেসবুকে নেই স্যার।’ বস বললেন, ‘রাবিশ। আজ রাতের মধ্যে পেজটা লাইক করবে। দিস ইজ দ্য কোম্পানি পলিসি। ধরে নাও এটা আমার অর্ডার।’ বন্ধু সাইবার কাফেতে গিয়ে তড়িঘড়ি, ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। ধরা দিয়েছিল আকাশের পাখি। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তৈরি হলো। মেশিনের ছবি লাইক হলো। লাইক ছবি শেয়ার হলো। এরপর সেই কবি বন্ধুর নিজেকে যন্ত্রদাস মনে হতে থাকে। লগ আউট করার আগে নিজের ওয়ালে লেখে-  টুইট করুন/শেয়ার করুন/পোস্ট করে দিন ওয়ালে/এই তো লিখছি/লাইক করুন/এখন পরে তোয়ালে।
তাও তো আমরা ফেসবুকের কাছে যাই। কমেন্ট দিয়ে লাইক গুনি। লাইকেরও বড় দাদার নাম সুপারলাইক। ওটা অবশ্য লিখে দিতে হয়। স্কুলের হেল্থ ড্রিংক খাওয়া স্মার্ট বাচ্চাদের কথায় কথায় আড়ি-ভাব করার দিন গিয়াছে চলিয়া। এখন তো বন্ধুত্বের ডিজিট্যাল সংস্করণ। ক্লাসের বন্ধু পিঙ্ক রঙের জেলপেনটা বা স্ট্রবেরির গন্ধওয়ালা রবারটা পাশের জনের সঙ্গে শেয়ার না করার জন্য সে রাতেই ওই বন্ধুর ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ডিলিট হয়ে যাবে কি নাÑ তা কে জানে! হালের মা-বাবারা তাদের লিলিপুটদের বলতেই পারেন, ‘শোনো সোনা, স্কুলে একদম ঝগড়া করবে না। যাকে ভালো লাগবে না, তাকে স্ট্রেট আনফ্রেন্ড করে দেবে। মনে রাখবে, ও জাস্ট তোমার বন্ধু, বাট ফ্রেন্ড নয়।’
বন্ধু হলো সিটি গোল্ড, আর ফ্রেন্ডের গায়ে বাইশ ক্যারেটের চমক।
বলা যায় না, ‘সব ক্ষারই ক্ষারক, কিন্তু সব ক্ষারকই ক্ষার নয়’-এর আদলে আর বছর কয়েকের মধ্যে হয়তো পরীক্ষায় প্রশ্ন আসবে, ‘ভাব সম্প্রসারণ করো-  সব ফ্রেন্ডই বন্ধু, কিন্তু সব বন্ধু ফ্রেন্ড নয়।’
আর ওই ফ্রেন্ডরা বড় হয়ে গেট টুগেদার করবে। না-কি নেট টুগেদার! তখন হয়তো টেন জি। ওরা পাশাপাশি বসবে। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে একটিও কথা বলবে না। মুখ ঢেকে যাবে স্মার্টফোনে।