সরদার ফজলুল করিমের জন্মদিন আজ

সরদার
সরদার ফজলুল করিম

দেশের বিখ্যাত দার্শনিক, শিক্ষাবিদ,  সাহিত্যিক প্রবন্ধকার সরদার ফজলুল করিমের জন্মদিন আজ। বিশ্বের মেহনতি মানুষের বিজয়ের দিনে ১৯২৫ সালের মহান মে দিবসের এই দিনে দেশের মাটিকে আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন এই জ্ঞান সন্ধিৎসু বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব। 

১৯২৫ সালের ১মে  ব্রিটিশ বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম বরিশাল জেলার উজিপুর থানার আটি পাড়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে সরদার ফজলুল করিম জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম খবির উদ্দিন সরকার, পেশায় ছিলেন কৃষিজীবী।  মা সফুরা বেগম ছিলেন গৃহিনী। তারা ছিলেন দুই ভাই, তিন বোন। নিজেকে অতিসাধারণ 'কৃষকের পোলা' হিসেবেই পরিচয় দিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। 

সরদার ফজলুল করিম ১৯৪০ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে ঢাকায় আসেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে, হোস্টেলে থেকেই করতেন পড়াশোনা।  ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ভর্তির সুযোগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। তবে ইংরেজি সাহিত্য থেকেও দর্শন শাস্ত্রে ছিলো অগাধ আগ্রহ। তা তিনি তার স্মৃতি সমগ্রেই উল্লেখ করেছেন।

তার স্মৃতি সমগ্রে তিনি লিখেন, করিডোরে দিয়ে যাওয়ার সময় দর্শনের অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্যের বক্তৃতা শুনে তিনি মুগ্ধ হন৷ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন ছিলো ঢাকা মেডিকেলের সামনে। পরে তিনি ১৯৪৫ সালে দর্শন শাস্ত্রে বিএ অনার্স প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৪৬ সালে এমএ ডিগ্রিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।  

অসাধারণ প্রতিভা  সম্পন্ন সরদার ফজলুল করিম পেয়েছিলেন বিলেতে পড়ার স্কলারশিপ। তবে দলের নেতাদের নির্দেশে ওই ইন্টারভিউ কার্ড ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তিনি। বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় দলের কথা চিন্তা করে লন্ডন পাড়ি না জমিয়ে ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। 

এ প্রসঙ্গে স্মৃতি কথায় তিনি লিখেন, ‘‘ইন্টারভিউ কার্ড নিয়ে আমি কলকাতায় যাই। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে না গিয়ে আমি প্রথমে গেলাম কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে। সেখানে মুজাফফর আহমেদ (যাকে আমরা কাকাবাবু বলতাম), নৃপেন চক্রবর্তী (যিনি পরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন)। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আমি তো বিলেত যাচ্ছি।’ ওঁরা শুনে হাসতে হাসতে ঠাট্টার ছলে বললেন, ‘আপনি বিলেত যাবেন আর আমরা এখানে বসে ভেরেণ্ডা ভাজবো?  কাঁথা-কম্বল নিয়ে পার্টি অফিসে চলে আসেন।’ তো কাঁথা-কম্বল নিয়ে পরের দিন আমি পার্টি অফিসে যাইনি কিন্তু ইন্টারভিউ কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।’’

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও বাঁধা হয়ে দাঁড়াল তার রাজনৈতিক জীবনে। শিক্ষকতার ব্যস্ততায় নিয়মিত সময় দিতে পারছিলেন না রাজনীতিতে। তাই ১৯৪৮ সালে রাজনীতির কারণে  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দেন। 

এসময় জিন্নাহর বাংলাদেশ সফর এবং রাষ্ট্র ভাষা ইস্যুতে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ থাকায় দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকতে হয়েছে বামপন্থী এই রাজনীতিবিদকে। তবে ১৯৪৯ সালে ঢাকা শহরের তাঁতি বাজারে তার কয়েকজন বন্ধু সহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনবারে দীর্ঘ ১১ বছর বিভিন্ন পর্যায়ে কারাভোগ করেছেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯৫৪ সালে তিনি পাকিস্তান সংবিধান সভার সদস্য হিসেবে কাজ করেন। এভাবেই একজীবনে বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞের উদ্ভাস ঘটান। অতঃপর ১৯৫৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।  

১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমির অনুবাদ শাখায় যোগ দেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমির সংস্কৃত শাখায় বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ওই বছরেই মুক্তিযুদ্ধের সময় সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক আবারো  গ্রেপ্তার হন । দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে ১৭ ডিসেম্বর দেশের মুক্ত মাটিতে পা রাখেন । পরবর্তী বছর আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাদান করেন। 

২০১৪ সালের ১৫ জুন ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন সরদার ফজলুল করিম। 

সরদার ফজলুল করিম বেশকিছু ধ্রুপদি বইয়ের অনুবাদ করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্লেটোর সংলাপ, প্লেটোর রিপাবলিক, অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স, রুশোর সোশ্যাল কনট্রাক্ট ইত্যাদি। এ ছাড়া দর্শনপাঠে আগ্রহীদের জন্য 'দর্শনকোষ' নামে একটি অনবদ্য বই লিখেছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।