প্রশাসনের ইন্ধনে পবিপ্রবিতে সাংবাদিকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, মামলার হুমকি

হামলার শিকার সাংবাদিক রাকিবুল ইসলাম তনু

মাস্টার্সে ভর্তির ক্ষেত্রে মানদণ্ড কমানোর দাবিতে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি) বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত উপাচার্য ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্তকে বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এই সংবাদ করতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন ৫ জন সাংবাদিক।

এ সময় সাংবাদিকদের ব্যবহৃত মোবাইল, ক্যামেরা ও ল্যাপটপ কেড়ে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলাসহ কয়েক আটকে রাখা হয়। পরে এই ঘটনায় সংবাদ প্রচার না করার শর্তে মুচলেকা নিয়ে মধ্যরাতে তাদের ছেড়ে দেয় পবিপ্রবি প্রশাসন ও ছাত্রলীগের একাংশের নেতাকর্মীরা।

শুধু তাই নয় এসব ঘটনায় সংবাদ প্রচার হলে সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে নারী সংক্রান্ত মামলা দেয়ার হুমকি দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সন্তোস কুমার বসু। এ সময় কয়েকজন মেয়ে শিক্ষার্থীও হামলার শিকার হন বলে জানা যায়। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সন্তোস কুমার বসু ও শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তারেকের ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন হামলার শিকার ওই শিক্ষার্থীরা ও সংবাদকর্মীরা। 

মারধরের শিকার সাংবাদিকরা হলেন ডেইলি সান ও বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধি আবদুল কাইউম, সময় টিভির ক্যামেরাপারসন সুজন দাম, বার্তা বাজারের প্রতিনিধি মো. নয়ন মৃধা, আনন্দবাজার ও বিডি২৪ লাইভের স্বপ্নীল দাস ও বাংলা ইনসাইডারের রাকিবুল ইসলাম তনু।

সূত্র জানায়, সিজিপিএ ও জিপিএ মানদন্ড তুলে নিয়ে মাষ্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির সিদ্ধান্ত স্থগিতের কারণে বুধবার থেকে ভিসিকে অবরুদ্ধ করে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। খবর পেয়ে পবিপ্রবিতে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে যান ডেইলি সান ও বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকার প্রতিনিধি আবদুল কাইউম, সময় টিভির ক্যামেরা পার্সন সুজন দাম, বার্তা বাজারের মো. নয়ন মৃধা, আনন্দ বাজার ও বিডি২৪ লাইভ এর স্বপ্নীল দাস, আজকের বসুন্ধরার রাকিবুল ইসলাম তনুসহ একাধিক সংবাদকর্মী।

রাত ৯টার দিকে ভিসি অবরুদ্ধের ভিডিওচিত্র নিতে গেলে পবিপ্রবি ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি আশরাফুল আলম  রুবায়েত এর হাতে মারধরের শিকার হন রাকিবুল ইসলাম তনু। এসময় তনুর মোবাইল ও ল্যাপটপ ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলেন ওই ছাত্রলীগ নেতা। 

রাত ১০টার দিকে বেগম সুফিয়া কামাল ছাত্রবাস থেকে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ডাক-চিৎকার শুনে উপস্থিত সংবাদকর্মীরা এগিয়ে যান।এরপর ওই শিক্ষার্থীরা সংবাদকর্মীদের কাছে সহায়তা চাইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে উপস্থিত সংবাদকর্মীরা বিষয়টি ভিসি স্বদেশ চন্দ্র সামন্তকে জানানোর চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় সংবদকর্মীরা ছাত্রবাসের ভেতরে নারী শিক্ষার্থীদের মারধরের দৃশ্য ধারণ করার চেষ্টা করেন।

এতে হামলাকারীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে সংবদকর্মীদের মোবাইল কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। পরে পরিস্থিতির অবনতি দেখে সংবাদকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট গেট এলাকায় অবস্থান করেন। এর কিছুক্ষণ পরে পবিপ্রবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তারেক ও পবিপ্রবি প্রশাসনের বরাত দিয়ে ডেইলি সান ও বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি আবদুল কাইউমকে জোর করে মোটরসাইকেলে করে তুলে নেন পবিপ্রবির ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রুবায়েত ও সাংগঠনিক সম্পাদক শিহাব বুখারি এবং তাদের লোকজন।

পরে পবিপ্রবির রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সন্তোষ কুমার বসুসহ একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতেই সাংবাদিক কাইউমকে কবি বেগম সুফিয়া কামাল হলের সামনে নিয়ে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারধর শুরু করেন ওই ছাত্র লীগ নেতাকর্মীরা। এসময় কাইউমের কাছ থেকে কর্মরত মিডিয়ার আইডি কার্ড, মোবাইল ও ল্যাপটপ কেরে নেয়া হয়। মারধর শেষে কাইউমের ব্যবহৃত মোবাইল থেকে সকল প্রকার তথ্য মুছে দিয়ে মোবাইলটি ভেঙ্গে ফেলেন ছাত্রলীগ নেতা রুবায়েত ও শিহাব। এসব ঘটনার ইন্ধন দেন রেজিস্টার সন্তোষ কুমার বসু। দুই ঘন্টার পর এই ঘটনার সংবাদ প্রকাশ না করার শর্তে কাইউমকে ছেড়ে দেন। ছেড়ে দেয়ার মুহুর্তে সংবাদ হলে নারী ঘটিত অভিযোগে সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলারও হুমকি দেন ওই রেজিস্ট্রার। 

বার্তা বাজারের প্রতিনিধি মো. নয়ন মৃধা বলেন, এসব ঘটনার সংবাদ না করার শর্তে ভিডিও স্বীকারোক্তি নিয়ে মধ্যরাতে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আমাদের ওপর হামলা হয়েছে। রাকিবুল ইসলাম তনুর মোবাইল ও ল্যাপটপ ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেলেন ছাত্রলীগ নেতা রুবায়েত। আমাদের ছাড়ার আগে মোবাইল ও ল্যাপটপ ভেঙে ফেলা হয়। পাশাপাশি এই ঘটনার সংবাদ প্রকাশ করলে মামলা দেওয়ার হুমকি দেন রেজিস্ট্রার ও রুবায়েত এবং তার অনুসারীরা।

সাংবাদিক আবদুল কাইউম বলেন, বেগম সুফিয়া কামাল হলের সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মারধর করা হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতি দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে একাধিকবার কল দিলেও ধরেননি। পরে মারধরের দৃশ্য ধারণ করতে গেলে আমার ওপর চড়াও হন ছাত্রলীগ নামধারী কয়েকজন। তারা আমার মোবাইল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি খারাপ দেখে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে দুমকি প্রেসক্লাবের চত্বরের একটি দোকানে গিয়ে সংবাদ লিখছিলাম। এ সময় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শিহাব উদ্দিন বুখারীর নেতৃত্বে আমাকে তুলে সুফিয়া কামাল হলের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. সন্তোষ কুমার বসুর সামনে আমাকে মারধর করেন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আশরাফুল আলম রুবায়েত ও শিহাব উদ্দিন বুখারীসহ কয়েকজন। পরে শিক্ষকরা আমাকে উদ্ধার করেন। তারা আমার মোবাইল ও আইডি কার্ড নিয়ে যান। সেইসঙ্গে ল্যাপটপ ভেঙে ফেলেন। পরে মারধর করা হয়নি এমন স্বীকারোক্তি নিতে আবারও মারধর করা হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয় এবং সংবাদ প্রকাশ না করার শর্তে আমাকে ছেড়ে দেন তারা।

হামলার শিকার তাহিরা লিজা বলেন, গত ৫ এপ্রিল স্নাতকোত্তর ভর্তি জটিলতা নিরসনের জন্য শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে কবি বেগম সুফিয়া কামাল হল থেকে বের হই। এসময় মেধা, ফারজানা, প্রীতি, অনন্যা, সারন, বিন্তি, নাজিফা, সুস্মিতা, আমরিন, সুমাইয়া, স্বর্ণা বিভিন্ন অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে আমাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে গণরুমে তুলে নেন। গণরুমে নেয়ার পরে তারা আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। এসময় হামলাকারীরা আমাকে বলেন, পবিপ্রবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তারেক ভাইয়ের নিষেধ থাকা স্বত্ত্বেও কর্মসুচিতে যোগ দেয়ার শাস্তি ভোগ করতে হবে। হামলার পরে সহপাঠীরা পবিপ্রবি হেলথ কেয়ার সেন্টারে নিয়ে গেলে তারা আমাকে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। এসময় আমাদের সহায়তা করতে এসে মারধরের শিকার হন কয়েকজন সাংবাদিক ভাইয়েরা।

এ প্রসঙ্গে পবিপ্রবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তারেক ও অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা আশরাফুল আলম খান রুবায়েতের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা ফোন রিসিভ করেন নি।

শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আরাফাত ইসলাম খান সাগর বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করতেই পারেন। তাদের ওপর হামলা করা ঠিক হয়নি। প্রশাসনের পক্ষ নিয়ে একটি মহল শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে। তারাই আবার সাংবাদিকদের মারধর করেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচার হওয়া উচিত। তারা ছাত্রলীগ হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পবিপ্রবির রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সন্তোস কুমার বসু বলেন, কিছু সংবাদকর্মীরা ছাত্রী হলে প্রবেশ করে মারামারির ভিডিও ধারণ করেছে। তাই তারা বাঁধার মুখে পরেছে। এখানে কোনো শিক্ষার্থী অথবা সাংবাদিককে মারধর করা হয়নি। শুধু ধাক্কা-ধাক্কি হয়েছে। আর কোনো শিক্ষার্থীকেও চিকিৎসা নিতে হয়নি।

এ বিষয়ে পবিপ্রবির ভিসি প্রফেসর স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত বলেন, সাংবাদিক মারধরের ব্যাপারে কিছু জানিনা। তবে কতিপয় শিক্ষার্থী অনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্য হৈ চৈ করেছিল। তাদের বিষয়টি একাডেমিক কাউন্সিলে নেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন গ্রুপিং আছে। তাই তারা বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করে। এসব  বিচ্ছিন্ন ঘটনা তারই ফলাফল।