ছিলেন ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও

মাতৃভূমি ও ঢাবির টানে ৪ যুগ পর আসছেন ‘৬৯-এ দেশ ছাড়া ছাত্র চন্দ্রশেখর

অধ্যাপক ড. চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী

১৯৬৯ সালের শেষের দিকের কথা। তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েক মাস বাকি। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগে মাত্রই ভর্তি হয়েছিলেন টাঙ্গাইলের চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী। টগবগে এই তরুণের ইচ্ছে ছিল দেশকে স্বাধীন করবেন। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রদের এগারো দফা কর্মসূচির আন্দোলনে যোগ দিতে চলে যান নিজ এলাকায়। তবে সেটা করতে গিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কুনজর পড়ে মুক্তিযুদ্ধের আগেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী। আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে।

এরপর দেশ স্বাধীন হলো, ১৯৭৭ সালে একবার বাংলাদেশে আসা হলেও চন্দ্রশেখর চক্রবর্তীর এরপর আসা হয়নি আর কোন দিন। ভারতেই উচ্চশিক্ষা, এরপর কয়েক দশক ধরে সেখানকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ছিলেন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বেও। এতোকিছু অর্জনের পরও দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসার টানে একবার এসে স্বচক্ষে দেখতে চান প্রিয়দেশ, মাতৃভূমির মাটি-আলো-বাতাস। প্রিয় ক্যাম্পাসের আঙ্গিনায় রাখতে চান পদধূলি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির পে-স্লিপ। ভর্তি হয়েছিলেন ১৪৪ টাকা দিয়ে।

অবশেষে প্রায় ৪ যুগ পর অপেক্ষার প্রহর শেখ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. চন্দ্রশেখর চক্রবর্তীর। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১২ এপ্রিল ঢাকায় আসবেন তিনি। পা রাখবেন দেশের মাটিতে। দুই সপ্তাহের জন্য মাতৃভূমিতে এসে প্রথমেই যাবেন প্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) বিষয়টি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে নিশ্চিত করেছেন তিনি। 

অধ্যাপক ড. চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী বলেন, ১২ এপ্রিল ঢাকার বিমানবন্দরে ল্যান্ড করার পর ওইদিন রাতে থাকবো সেখানে, পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে যাবো। বিভাগের বিভাগী প্রধানের সঙ্গে কথা হয়েছে, উনি আগে সেখানে যেতে বলেছেন তাই যাবো। এরপর ১৪ তারিখ সকালে গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবো। ২৬ তারিখ ফের চলে আসবেন ভারতের কলকাতায়। ১৯৬৬ সালে দেশে ছেড়ে চলে আসার পর ১৯৭৭ সালে একবার গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। এরপর আর যাওয়া হয়নি।

২০০৬-১৪ সাল পর্যন্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক ড. চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী

সম্প্রতি ফেসবুকের একটি পেজে বাংলাদেশে আসার আকুতি জানিয়ে একটি পোস্ট দেন অধ্যাপক ড. চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী। পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র শিক্ষকদের সহযোগিতা চাইছি। আমি ভারত থেকে অধ্যাপক ড. চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। গত ৩ মার্চ আমি লিখেছিলাম ১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরের কাঁঠালিয়া কুমুদিনী হাসপাতালে জন্মেছিলাম।

“টাঙ্গাইলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে, স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলাম বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলজি ডিপার্টমেন্টে (প্রাণিবিদ্যা বিভাগ)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বলগ্নে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কুনজর আমার ওপর পড়লে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হই।”
 
পোস্টে তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমি বাংলাদেশে যেতে চাই তাই ভিসা করতে দিয়েছি। ভিসা পেলে আগামী ১২ এপ্রিল বিমানে ঢাকা আসছি। আমার পাঠস্থান করটিয়া টাঙ্গাইলের এইচএম ইনস্টিটিউশন এবং সা’দত কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলজি বিভাগে গিয়ে মাননীয় শিক্ষক ও অধ্যাপকদের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী।
 
এই পোস্টের সূত্র ধরে অধ্যাপক ড. চন্দ্রশেখর চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। বর্তমানে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন কলকাতায়। ছিলেন বঙ্গবাসী কলেজ কলকাতা, উত্তর বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য।
 
কিভাবে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেলেন, সে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অধ্যাপক ড. চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী বলেন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পর ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলে যে পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে তাদের কোন ভাবেই মিলছে না। এরমধ্যে তিনি ‘বাংলাদেশ’ শব্দটিও ব্যবহার করে ফেলছেন। সেসময় ১১ দফা আন্দোলন চলেছিল, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জগন্নাথ হলে ছিলাম কিছুদিন। কারণ ভর্তি হতে হয়েছিল অনেক পরে, কারণ ভর্তি পিছিয়ে গিয়েছিল। তারপার ক্লাস শুরু হওয়ার আগে আমাদের নেতারা বলে দিলেন যে এখন আর ক্লাস হবে না তোমরা সবাই গ্রামে চলে যাও।

“গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে ১১ দফা কর্মসূচির আন্দোলন নিয়ে প্রচারে যাওয়ার ফলে তখন পুলিশে নজরে পড়ে গেলাম। তখন গ্রামের ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিন্ডের কাছে থানা থেকে একটি তালিকা এসেছিল। সেখানে যেসব ছাত্ররা এর সঙ্গে জড়িত তাদের তালিকা ছিল এবং তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। সেটা জানার পর তখন আর যাওয়ার কোথায় রাস্তা ছিলনা তাই ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে ভারতে চলে এলাম।”

তিনি আরও বলেন, ভারতে গিয়ে কলকাতায় উঠলাম। সেখানে আবার নতুন জীবন শুরু করি। কেননা সব কিছুইতো নতুন ছিল। তারমধ্যে কলেজ ভর্তি হতে গিয়ে প্রথমে নিতে চাইল না। পরে কলেজ থেকে বলা হলো, এখানে ভর্তি হতে লিখিত পরীক্ষা (রিটেন টেস্ট) দিতে হবে এবং উত্তীর্ণ হলে ভর্তি নেওয়া হবে। সেই রিটেন টেস্ট দিয়ে সেখানে স্নাতকে পড়াশোনা শুরু করি। এরপর স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি সম্পন্ন করে তারপর কলেজে চাকরি শুরু করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা।

“প্রথমে একটা কলেজে ১০ বছর অধ্যাপনা করে তারপর উত্তর বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম। সেখান থেকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়ে চলে এলাম। সবকিছু মিলে খুবই কষ্ট-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। কেননা সবকিছুতো ভিন্ন ছিল। তবে দেশে থাকাকালীন সময়ে যে লেখাপড়া করেছি এখানে এসে সেটি অনেক কাজে লেগেছে। তাই পড়াশোনায় তেমন একটি সমস্যা পড়তে হয়নি। তবে জীবনযাত্রা কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। টিউশন করে পাড়শোনা চালাতে হয়েছিল।”

২০০৬-১৪ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী। বর্তমানে নয়া দিল্লির অনানারি রিজনাল এডভাইজার অফ এনএইএবি, আইসিএআর-এ দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ও তার আগে তার পরিচিত আর কেউ ভারতে গিয়েছিলেন কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সে সময় আমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকে ভারতে এসেছিল। তারমধ্যে একজন অনেক বড় নেতা ছিলেন। তিনি হলেন বঙ্গবীর কাদের কাদের সিদ্দিকী। তিনি আমার বিশ্ববিদ্যায়ের বন্ধু ছিলেন। আমার একই সেশনে ছিলাম।