বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতি নিতে এসে ‘ডাকাতির’ শিকার ভর্তিচ্ছুরা

কোচিং সেন্টার
ফার্মগেট এলাকার কোচিং সেন্টার

দরজায় কড়া নাড়ছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা। আগামী শুক্রবার (১০ মার্চ) সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হবে এবারের ভর্তিযুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আগে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও রাজধানীর ফার্মগেটের কোচিংপাড়ার দৃশ্যগুলো যেন চিরচেনা। হাতে কয়েকটা শিট কিংবা কাঁধে পুরানো ব্যাগ, পায়ে চটি জুতা পড়া অনেক অজপাড়া গাঁয়ের তরুণদের দেখা মেলে ওই এলাকায়। আবার অনেক তরুণ-তরুণীকে দেখা যায় সুন্দর-পরিপাটি জামা গায়ে। তাবে তাদের বাহ্যিক দিকটা যেমন হোক না কেন সবারই চোখে–মুখে একটাই স্বপ্ন, একটা সিট, একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। 

ফার্মগেটের কোচিংপাড়ায় রয়েছে অর্ধশত কোচিং সেন্টার। এদের মধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল ভর্তিকেন্দ্রিক; আবার কিছু রয়েছে একাডেমিক কিংবা ভিনদেশি ভাষা শেখার কোচিং। প্রতিবারই এসব কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে এসে ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন একদল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী। কোচিং সংশ্লিষ্ট এলাকার কথিত বড় ভাইদের মাধ্যমে কম টাকায় ভর্তি হতে গিয়ে এ অবস্থায় পড়তে হয় তাদের।

তথ্য মতে, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পরপরই দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে ভর্তির জন্য রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় আসেন। প্রতি বছরই এই সময়ে কিছু সংখ্যক নেতাকর্মী শিক্ষার্থীদের প্রলোভন দেখিয়ে কম টাকায় ভর্তি করানোর কথা বলে কোচিংগুলো থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন।

অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা মহানগর উত্তর, তেজগাঁও কলেজ ও স্থানীয় শাখা ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী ভর্তিচ্ছু এসব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কম টাকায় ভর্তি করানোর প্রলোভন দেখিয়ে কোচিংগুলোতে নামমাত্র টাকা দিয়ে ‘আপোসে চাঁদাবাজি’ করছেন। যে প্রক্রিয়ায় ভর্তি হয়ে অনেক সময়ই শিক্ষার্থীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে লাখ লাখ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন কোচিং সেন্টারগুলো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফার্মগেট এলাকার কোচিং সেন্টারের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন ভর্তি পরীক্ষার মৌসুম চলছে। এটাকে কেন্দ্র করে তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের নাম করে কয়েকটা গ্রুপ বিভিন্ন কোচিংয়ে নামমাত্র টাকায় ভর্তি করিয়ে দেন। কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার মূল ফি ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা হলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তারা ১০ হাজার টাকা নিয়ে তিন কিংবা পাঁচ হাজার টাকা কোচিংকে ধরিয়ে ভর্তি ফর্ম ফিলাপ করেন। 

তিনি আরও বলেন, তেজগাঁও কলেজ ও কোচিংগুলো একই এলাকায় হওয়ায় মালিক পক্ষ এ বিষয় নিয়ে কখনও ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান না কিংবা কখনও কাউকে ‘না’ বলেন না। তার দাবি, প্রায় সব কোচিংগুলোতে গরীব ও মেধাবী কোটা থাকে। ফলে ছাত্রলীগের নামধারী কেউ এসে ওই কোটায় শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে দেয়। এক প্রকার আপোসেই চাঁদাবাজি করেন তারা। 

মূলতঃ দুইভাবে ছাত্রলীগের ফাঁদে পা দেন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। ফার্মগেট এলাকার কোচিং সেন্টারের আরেক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কেউ কেউ না জেনে ছাত্রলীগের বড় ভাইদের মাধ্যমে কম টাকায় ভর্তি হতে আসেন। আবার কেউ কেউ জেনেশুনে এসব বড় ভাইদের মাধ্যমে ভর্তি হয়ে থাকেন।  

এর ফলে আল্টিমেটলি ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকেন, জানান ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এভাবে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে ব্যাচ করে পড়ানো হয়। ফলে অন্য ব্যাচের চেয়ে তাদের টেক-কেয়ারও কম করা হয়।  

এমন চাঁদাবাজির ঘটনার ব্যাপারে কোনও কোচিংয়ের কর্তৃপক্ষই কথা বলতে রাজি হননি। কেউ বলেছেন, এমন চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেনি। তবে তেজগাঁও কলেজ আমাদের প্রতিবেশী। পরিচিত হলে আমরা কিছু কমিয়ে ভর্তি নিয়ে নেই। প্যারাগন কোচিংয়ে পরিচালক মো: আবু জাহেদ বলেন, বিএনপির আমলে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটতো। আওয়ামী লীগের আমলে হয় না। 

তবে ফার্মগেটে ইংরেজি ব্যাচ পড়ানো এক শিক্ষক জানান, আমি নিজেও এক কোচিংয়ে পড়াই। আবার আলাদা করে ব্যাচও পড়াই। কোচিং কর্তৃপক্ষ এক ধরনের আপোসের মধ্য দিয়েই চলে। তাই তারা কিছু বলছেন না। চাঁদা নেওয়া অধিকাংশ তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী বলে জানান তিনি। শাখা কলেজ ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতাদের অভিযোগ দেয়া হয় না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভয়ে অভিযোগ দেন না। যদি কোচিংয়ের বাইরে কোনও শিক্ষার্থীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, তাহলে কোচিংয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে যেতে পারে।  

এ বিষয়ে তেজগাঁও কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী আমিন জানান, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের কোচিংয়ে চাঁদাবাজি করার বিষয়টি সাধারণ ব্যাপার। তারা এর চেয়েও বড় অপরাধ করে থাকে। কোচিংয়ের বিষয়ে তাদের একটা নেটওয়ার্ক আছে। সেই নেটওয়ার্কে কাজ করলে যে কেউ কমিশন ভিত্তিতে এক্সট্রা টাকা পেয়ে থাকেন। তিনি আরও জানান, চাঁদাবাজি সাধারণত সিনিয়র নেতারাই করে। মাঝেমধ্যে কোনো জুনিয়রকে কোচিংয়ে গিয়ে ফোন ধরিয়ে দিতে বলেন।

সম্প্রতি তেজগাঁও শাখা ছাত্রলীগের রবি নামের একজনের মাধ্যমে কম খরচে কোচিংয়ে ভর্তি হতে গিয়ে প্রতারণা শিকার হয়েছেন উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় প্রথমবার আসা রাসেল আহমেদ (ছন্দনাম)। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি জানান, ‘‘কম টাকায় ভর্তি করাবে বলে রবি ভাই আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে বলল তুই বাইরে দাঁড়া, আমি ভেতরে গিয়ে তাজিম (তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক) ভাই কিংবা রবিন (তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি) ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দিয়ে তোর ভর্তি কনফার্ম করে দিচ্ছি। ভর্তি কনফার্ম হওয়ার পর ক্লাস করতে এসে কোচিং থেকে আমাকে জানানো হয়, আমি তো শর্ট কোর্সে ভর্তি হয়েছি। পরে পুনরায় ফুল ফি দিয়ে আমি ভর্তি হই। 

রবি নামের বড় ভাইয়ের সাথে কিভাবে পরিচয় হয়েছে জানতে চাইলে ওই ছাত্র জানান, আমার ফ্রেন্ডের পরিচিত একজন তেজগাঁও কলেজে পড়তেন। সে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। রবি ভাই বলেছিল, আরও ছাত্র যোগাড় করে দিতে পারলে আরও কমে ভর্তি করিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু আমি তেমন কাউকে আনতে পারিনি। এজন্যই হয়তো তিনি এমনটা করেছেন। আমাদের মতো নবীন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ ‘এক ধরনের ডাকাতি’।’’

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ে ভর্তি হওয়া আরেকজন শিক্ষার্থী ধীমান (ছদ্মনাম)। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, এমনই এক প্রক্রিয়ায় তার কলেজের ৫-৭ জন গাজী নামের তেজগাঁও কলেজের ছাত্রলীগের এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে কম টাকায় কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছেন। ধীমান জানান, তারা ভর্তির জন্য কোচিং সেন্টারে নয়, ছাত্রলীগ নেতাকে টাকা দিয়েছেন। জনপ্রতি ১৬ হাজারের জায়গায় তাদের থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছিল। তবে কোচিং সেন্টারে তারা কত দিয়েছেন, তা আমি জানি না। 

গাজী মামুন নামের তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের সেই নেতার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। কোচিং সেন্টারে ‘আপোসে চাঁদাবাজি’র বিষয়ে তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে আমি ফোনে কিছুই বলব না। আপনি ফার্মগেট আসেন, তারপর বলতেসি!” এসময় তিনি মুঠোফোনে অভিযোগ স্বীকার কিংবা অস্বীকার কোনটিই করতে রাজি হননি। 

‘আপোসে চাঁদাবাজি’র অভিযোগটি অস্বীকার করে তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মইনুল ইসলাম তাজিম বলেন, ক্যাম্পাসের বাইরে কোনও চাঁদাবাজির সঙ্গে আমার কোনও সম্পৃক্ততা নেই। আমি ছাত্রদের নেতা। কলেজের ভেতরে ছাত্রদের কী সমস্যা, কী করলে ভাল হবে- এসব নিয়েই কাজ করি। তবে এরকম অভিযোগ আগেও শুনেছি। কাউকে সরাসরি ধরতে পারি নি।  মইনুল ইসলাম তাজিমের কাছে কোচিংয়ে চাঁদাবাজি করার অভিযুক্ত কলেজ ছাত্রলীগ নেতা গাজী সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ওকে (গাজী) চিনতে পেরেছি। তবে ওর সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না। ও আমার লোক না। 

এ বিষয়ে তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান রবিন বলেন, ফার্মগেট এলাকার কোন কোচিং সেন্টারে আমাদের কোনও নেতাকর্মী চাঁদাবাজি করতে গেছে— এটা জানতে পারলে বা কেউ আমাদের অভিযোগ দিলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।

তিনি আরও বলেন, আমরা ফার্মগেটে অনেকদিন ধরে রাজনীতি করি। সব কোচিং সেন্টারগুলোর সংশ্লিষ্টদের বলে দেওয়া আছে যে, কেউ যদি কলেজ ছাত্রলীগের অথবা আমাদের নাম ভাঙ্গিয়ে কোনও টাকা দাবি করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের জানাবেন। আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব। প্রতিটি কোচিং সেন্টার সংশ্লিষ্টদেরকে এতোবার করে বলার পরেও তারা আমাদেরকে অভিযোগ না দেওয়ার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন প্রতারিত হওয়াটা দুখঃজনক বলে তিনি মনে করেন।

ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ বলেন, অনেক সময় ছোট ভাই কিংবা অভাবগ্রস্থ কেউ যদি আমাদের কাছে এসে অনুরোধ করে তাহলে আমরা কোচিং সেন্টারে সমস্যার কথা বলে কিছু কমে ভর্তি করিয়ে দেই। এটা তো কোনও চাঁদাবাজি না। তবে যদি এমনটা হয়ে থাকে তাহলে ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক।