র‌্যাগিংয়ের নামে যা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইছিস আর র‌্যাগ খাবি না তা কি হয়? পড়ালেখার মত এটাও (র‌্যাগিং) বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অংশ। র‌্যাগ খেলেই আদব-কায়দা শিখতে পারবি’— প্রথম বর্ষে থাকাকালীন র‌্যাগিংয়ের সময় সিনিয়রদের কাছ থেকে শোনা কিছু বাক্য এভাবেই দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের নিকট তুলে ধরেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী। ২০২০২-২১ শিক্ষাবর্ষের এই শিক্ষার্থী র‌্যাগিংয়ের জেরে ৪ মাসের মধ্যেই দুইবার মেস পরিবর্তন করেন। তবে নতুন জটিলতা তৈরি হতে পারে এমন আশঙ্কায় বিষয়টি জানাননি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে।

র‌্যাগিংয়ের বর্ণনা দিয়ে ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, রাত ১১টা বাজলেই সিনিয়র ভাইদের রুমে ডাক পড়ত। শুধু আমি একা নই, প্রথম বর্ষের যারা ওই বিল্ডিংয়ে (মেস) ছিল সবাইকেই ডাকা হতো। এরপর শুরু হত র‌্যাগিং। হাত দিয়ে না ধরে সিগারেট খাওয়ানো, গালি দেয়ানো, একজনকে ছেলে আরেকজনকে মেয়ে সাজিয়ে প্রেমের অভিনয় করানো, বিভিন্ন যৌন আবেদনময়ী অঙ্গভঙ্গি করানো এগুলো ছিল নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। কেউ এসবে রাজি না হলে মারধর করা হত এবং কখনও কখনও আরো খারাপ কিছু করতে বাধ্য করা হত।

প্রশাসনের ভূমিকা সম্পর্কে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী বলেন, আমরা ক্যাম্পাসের বাইরে থাকায় প্রশাসন এসব সম্পর্কে খুব বেশি জানতো না। আবার যারা র‌্যাগ দিত তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটিামুটি প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসনকে আামরা জানাতে সাহস পেতাম না। এছাড়া অনেকসময় সিনিয়ররা র‌্যাগ দিয়ে পরবর্তীতে আমাদের সাথে ভালো সম্পর্ক করে নিতো তাই নতুন কোনো ঝামেলা চাইতাম না। তবে যতই ভালো সম্পর্ক করুক র‌্যগিংয়ের ফলে যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেই ক্ষত কখনও ঠিক হওয়ার নয়।

শুধুমাত্র বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এমন চিত্র দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিগত কয়েকবছরের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিবারই র‌্যাগিংয়ের জেরে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। বেশ কিছুদিন গণমাধ্যমে আলোচনায়ও থাকে এসব ঘটনা। কিন্তু এতে বন্ধ হয়না পরিচিতি পর্বের নামে নবীন শিক্ষার্থীদের শারীরিক নিপীড়ন। নতুন শিক্ষাবর্ষ এলেই আবারো ঘটে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির তদন্তে থেকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির সুপারিশ করা হয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কোনো ব্যবস্থা নেয় না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নামকাওয়াস্তে সাময়িক বহিষ্কারের মতো শাস্তি দিয়ে দায় সারা হচ্ছে।

একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, র‌্যগিংয়ের নামে বর্তমানে মূলত শিক্ষার্থীদের ওপর এক প্রকার যৌন নিপীড়ন চালানো হয়। এর মধ্যে কিছু ঘটনা প্রকাশ পেলেও অধিকাংশ ঘটনাই থাকে আড়ালে। র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় জড়িত সিনিয়ররা অধিকাংশ প্রভাবশালী হওয়ায় এসব ঘটনা প্রকাশের সাহস পান না জুানয়র শিক্ষার্থীরা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাকে মোট দুইবার সিনিয়ররা ডেকেছিলেন। প্রথমদিন আমার কাছে আমার ক্রাশের (পছন্দের বান্ধবী) নাম জানতে চেয়েছিল এরপর বলেছিলেন ক্রাশের সাথে আমার বিয়ে হলে বাসররাতে কি করবো অভিনয় করে দেখাতে। আমি রাজি না হলে মারধর করেছিল। এরপর একটা হিন্দি গানের ভিডিও দেখিয়ে সেই অনুযায়ী ১৫ মিনিট ধরে নাচিয়েছি। আর দ্বিতীয় দিনে আমাদের সাথে এমন কিছু করা হয়িনি। ওইদিন শুধু নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় প্রপোজ করানো হয়, গান গাওয়ানো হয় এবং এসব শেষে সিনিয়ররা আমাদের সবাইকে নিয়ে পিকনিক করেন।

অনেকটা একইরকম অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাকে একজন পর্ণ অভিনেত্রীর নাম বলে তার মত অভিনয় করতে বলা হয়েছিল। আমি রাজি না হলে আমাকে আমার বন্ধুদের দিয়ই মারধর করা হয়। এরপর প্রায় ৫০টি মরিচ দিয়ে একসাথে খেতে বলা হয়, হাত দিয়ে না ধরে গ্লাসে পানি খেতে বলা হয়। আমি এসব করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পরে আমাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। একটু সুস্থ হলে তৃতীয় বর্ষের কয়েকজন বড় ভাই বিষযটা মিমাংসা করেন।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, এক বড় ভাইকে সালাম না দেয়ায় তিনিসহ তার কয়েকজন বন্ধুর দ্বারা র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়েছিলাম। তারা আমাকে প্রথমেই মারধর করেছিল। এসময় পাশে দাঁড়ানো এক ভাই সিগারেট খেয়ে আমার মুখে ধোয়া ছাড়লে আমি কাশতে শুরু করি। এতে তারা বুঝতে পারে আমি সিগারেট খাই না। তখন আমাকে প্যাকেটের তিনটা সিগারেট ৩ মিনিটে শেষ করতে বলে। আমি মারধর থেকে বাচতে একটা সিগারেট খাই। এসময় কাশির কারণে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে আমাকে সিগারেটের খালি খোসা দিয়ে ক্যাম্পাস মাপতে বলে। এভাবে প্রায় রাত ১টা বাজরে তারা আমকে নিয়ে পাহাড়ে যায় এবং অন্তর্বাস ছাড়া সকল পোশাক খুলিয়ে শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করে।

এই শিক্ষার্থী আরো বলেন, যারা র‌্যাগ দিয়েছিল তারা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, অন্যদিকে আমি খুবই গরীব পরিবারের সন্তান। টাকার অভাবে এক বড় ভঅইয়ের হাত-পা ধরে হলে থাকতাম। তাই এসব নিয়ে আর অভিযোগ জানানোর সাহস পাইনি।

ভর্তির মাত্র ১২ দিনের মাথায় সম্প্রতি র‌্যাগিংয়ের শিকার হওয়া সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, ভাইয়েরা আমাদের মধ্য থেকে একজন যেন অন্যজনকে ধর্ষণ করে― এমন দৃশ্য দেখাতে বাধ্য করেন। এ ছাড়া যৌনকর্মী সেজে তার দেহ প্রদর্শন ও খরিদদার ধরার দৃশ্য প্রদর্শন করান। তৃতীয় লিঙ্গের ট্রেনে টাকা নেওয়ার দৃশ্য, কয়েকটি যৌন উত্তেজক গানের উত্তেজক দৃশ্য দেখানোসহ পরিচয় চেয়ে বিভিন্ন শব্দকে পরিবর্তন করে যৌনতা সম্পর্কিত শব্দ যোগ করে বলতে বলেন। বলতে অস্বীকার করলে শারীরিক নির্যাতনের হুমকির পাশাপাশি অনবরত ধমক দিয়ে বলতে বাধ্য করছিলেন। ভুক্তভোগী এই শিক্ষার্থীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে র‌্যাগিংয়ের দায়ে ৫ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

শুধুমাত্র ছেলেরাই নয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছেন মেয়েরাও। সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীকে র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। ওই শিক্ষার্থীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল, মারধর এবং বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল। এ ঘটনা কাউকে জানালে তাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হয়েছিল।

এই ঘটনার কয়েকদিনের ব্যবধানে রাজধানীর ইডেন কলেজের এক শিক্ষার্থীকে স্ট্যাম্প দিয়ে মারধর করেন সিনিয়র এক শিক্ষার্থীকে। এছাড়া এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সিনিয়ররা নিয়মিতই জুনিয়রদের মানসিক নির্যাতন ও মারধর করেন। এমনকি অনেক সময় ছেলেদের সঙ্গ দিতে বাধ্য করানো হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া এক নারী নবীন শিক্ষার্থী জানান, তাদের সিনিয়রদের বিভিন্ন ছোট ছোট কাজ করে দিতে হয়। কাজে ভুল হলে কিংবা কোনো কথার অবাধ্য হলে তাদের গালিগালাজ করা হয়। এছাড়া ঘর মোছা, চামচ দিয়ে পানি মাপাসহ বিভিন্ন শাস্তি পেতে হয়। বিষয়গুলো খুব মারাত্মক পর্যায়ে না পৌছালেও এসব থেকে তারা মুক্তি চান। এ কারণে প্রথম বর্ষের কয়েকজন মিলে বাসা ভাড়া নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিংয়ের অপরাধে ৬ শিক্ষার্থীকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এর আগে ২ জানুয়ারি দিবাগত রাত সোয়া ১২টায় বঙ্গবন্ধু হলের ছাদে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের চার শিক্ষার্থীকে র‍্যাগিং দেওয়ার সময় ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এসব শিক্ষার্থীকে হাতেনাতে ধরা হয়। 

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদাৎ হোসেন আজাদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় হাইকোর্টের পক্ষ থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এবং হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোট তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২-৩ দিনের মধ্যেই আমরা হয়ত তদন্ত রিপোর্ট পেয়ে যাবো। রিপোর্ট অনুযায়ী আমরা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিব।

র‌্যাগিংয়ে জড়িত শিক্ষার্থীদের নৈতিক অবক্ষয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা যাতে এ ধরনের ঘটনায় না জড়ায় তার জন্য বেশ কিছু সংগঠনের কাউন্সেলিং কার্যক্রম রয়েছে। তারপরও যেটি ঘটেছে সেটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, র‌্যাগিংয়ের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলছেন। কেউ এ ধরনের ঘটনায় জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।