বাংলা ছাড়াও ৪০ ভাষা দেশে, ১৪টি বিলুপ্তির পথে

বাংলা ছাড়াও ৪০ ভাষা দেশে, ১৪টি বিলুপ্তির পথে
বাংলা ছাড়াও ৪০ ভাষা দেশে, ১৪টি বিলুপ্তির পথে

বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে যে কয়টি কারণে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে অন্যতম ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি। কিন্তু সেই বাংলাদেশেই বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো মাতৃভাষা। ধারণা করা হচ্ছে ৩০-৪০ বছর পর এসব ভাষার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।

দেশে মোট মাতৃভাষা ৪১টি। এর মধ্যে আদিবাসী ভাষা ৩৩টি। ২০১৮ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের (আমাই) নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, বাংলা ও উর্দু ছাড়া এর বেশির ভাগই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষা। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে ১৪টি মাতৃভাষা বিপন্ন হওয়ার পথে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’র প্রথম খণ্ডে উল্লিখিত বিপন্ন মাতৃভাষাগুলো হলো- রেংমিটচা, চাক, সৌরা, খিয়াং, খুমি, কোল, কোডা, পাত্র, লুসাই, পাংখোয়া, কন্দ, খাড়িয়া, মালতো ও মুণ্ডারি।

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, যেসব ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা পাঁচ হাজারের নিচে সাধারণত সেগুলোকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ১৪টি ভাষার মধ্যে অন্তত ছয়টি ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা হাজারেরও নিচে।

তেমনি একটি ভাষা হচ্ছে রাঙামাটি সাজেক আঞ্চলের শৌরা ভাষা। এই ভাষায় কথা বলে মাত্র পাঁচ জন মানুষ। পার্বত্য এলাকার রেংমির্চা ভাষা অবস্থাও একই রমক। এ ভাষায় কথা বলে মাত্র জনাচল্লিশেক মানুষ। এদের সবার বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে।

আরও পড়ুন: গুগল ট্রান্সলেটে চাটগাঁইয়া ভাষা যুক্ত হওয়ার বিষয়টি সত্য নয়

ভাষা গবেষকরা মনে করছেন, জীবিত এই মানুষগুলোর মৃত্যুর পরই এই ভাষাগুলোতে কথা বলার মত আর কেউ থাকবে না। ফলে ভাষাগুলো হারিয়ে যাবে চিরতরে।

দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় মাত্র ঊনিশটি পরিবারের শখানেক মানুষ কথা বলে ‘কড়া’ ভাষায়। শুধু শৌরা বা রেংমির্চা নয়- এরকম বিপন্ন ভাষার তালিকায় রয়েছে কোদা, মেগাম, পাঙ্গুখুয়া, বম, চাক, আসোচিন, মরু, কুরুক্স, প্নার, সৌরিয়া, খেয়াং, কড়া, খোজী, কন্দু, মুণ্ডা ইত্যাদি ভাষা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ শিকদারের ভাষ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এরকম বিপন্ন ভাষার পরিমাণ ১৪টি। যার সব কয়টিই আদি ভাষা।

এসকল ভাষায় যারা কথা বলেন তাদের উত্তরসূরীরা কেন এ ভাষায় কথা বলছেন না-এমন প্রশ্নের জবাবে সৌরভ শিকদার বলেন, এসব ভাষা শিখে তাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। এসব ভাষার কোনো ব্যবহারিক দিক না থাকায় তারা এসব ভাষা শিখতে আগ্রহী হচ্ছে না।

তথ্য বলছে, ইতোমধ্যে দেশে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভাষার মধ্যে পুরোপুরি হারিয়ে গেছে এমন ভাষাগুলো হলো রাজবংশী, রাই, বাগদি, কোচ, হদি ও ভালু ইত্যাদি। ওঁরাও, মুণ্ডা, মালো, রাউতিয়া, মুশহর ও শবর ভাষাভাষী লোকেরাও নিজেদের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারেনি।

গবেষকরা বলছেন, সিং, কর্মকার, গণ্ড, বেদিয়া, বর্মন ও লোহার ভাষাও আগামী কোন এক সময় ঝুঁকির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) মতে, পৃথিবীতে কোনো ভাষায় যদি কথা বলা লোকের পরিমাণ পাঁচ হাজারের কম হয় তবে তা বিপন্ন ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হবে। এই হিসেবে বাংলাদেশে বিপন্ন ভাষার পরিমাণ ১৪টি।

ভাষা বিজ্ঞানী সৌরভ শিকদার বলেন, বিশ হাজার লোক কথা বলে এমন ভাষাও আমাদের দেশে আছে। তবে আমরা সেগুলোকেও বিপন্ন ভাষার তালিকায় রেখেছি। কারণ এর পরে এই ভাষাগুলোতে কথা বলা বা চর্চা করার মতো কেউ থাকবে না।