গুচ্ছ পদ্ধতি ধরে রাখতে চান শিক্ষামন্ত্রী, বেরিয়ে যেতে হাঁসফাঁস শিক্ষকদের

গুচ্ছ-ভুক্ত ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে শিক্ষার্থীরা
গুচ্ছ-ভুক্ত ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে শিক্ষার্থীরা

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য সার্বিক ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ করতে ২০২০-২০২১ সেশন থেকে শুরু হয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। স্বায়ত্তশাসিত ও বিশেষায়িত ছাড়া প্রথমবার ২০ বিশ্ববিদ্যিালয় নিয়ে শুরু হরেও পরের বছর থেকে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে শুরু হয় এ ভর্তি প্রক্রিয়া। এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য বিবেচনায় যতটুকু ইতিবাচক আশার সঞ্চার করার কথা ছিল দুই সেশনে ভর্তি কার্যক্রম চালিয়ে তার চেয়েও বেশি হতাশার সৃষ্টি করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গেল দুই বছরের ভর্তি পরীক্ষায় দীর্ঘসূত্রিতা, ভর্তিতে কালক্ষেপণ, উপাচার্যদের সিদ্ধান্তহীনতা, ভর্তিতে নানা জটিলতা ও হয়রানিতে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদেরই গুচ্ছে থাকতে অনীহা তৈরি করেছে। একইসঙ্গে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে নানা আশা সঞ্চার করা সমন্বিত এ ভর্তির উদ্যোগের। এ পদ্ধতি থেকে বের হতে হাঁসফাঁস অবস্থা বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের।

তবে, নানা আলোচনা সমালোচনার পরও গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। অন্যদিকে নানা আলোচনা-সমালোচনা ও সহজ-সরলের নানা হিসেব-নিকেশে অনেকটাই ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতি।

আরও পড়ুন: গুচ্ছ ভর্তি আবেদন ফি দ্বিগুণ, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ভর্তিচ্ছুদের

শিক্ষামন্ত্রী গত ৮ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে চলতি বছরের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তিনি একটি ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা চান। প্রয়োজনে স্যাট (একজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য কতখানি তৈরি, তা এ পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হয়ে থাকে)–এর মতো ব্যবস্থা তার সমাধান হতে পারে বলেও ইঙ্গিত করেরেছেন তিনি। 

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে একটি পরীক্ষা হয়। সেখানে হয়তো গণিত, বিজ্ঞান বা ভাষা—এ জাতীয় বিষয় এবং সাধারণ জ্ঞানের ওপর পরীক্ষা হয়। সেই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে যারা এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষা দিচ্ছে, তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আবারও একই বিষয়ের ওপর পরীক্ষা দিচ্ছে। সেটি না করে ভাষা, গণিত, সাধারণ জ্ঞানের ওপর একটি পরীক্ষা হওয়া উচিত। আর যতক্ষণ না পর্যন্ত সেটিতে যেতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যমান গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষা ব্যবস্থাপনাকে আরও ভালো করতে হবে।

দীপু মনি মনে করেন, গুচ্ছ পদ্ধতিতে যেতে যত সময় লেগেছে, নতুন পদ্ধতিতে যেতে তত সময় লাগবে না। তিনি জানান, উপাচার্যদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সঙ্গে কথা বলে যে ধরনের মতামত পাওয়া গেছে তাতে মনে হয়, হয়তো অনেক কম সময়েই নতুন পদ্ধতিতে যাওয়া যাবে।

এর আগে গত বছরও শিক্ষামন্ত্রী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলেন, আমরা প্রথমবারের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছি। কিছু ভুলত্রুটি থাকবেই। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে ভুলত্রুটি সংশোধনের মাধ্যমে গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বের না হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।

গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যেতে হাঁসফাঁস একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান বলেন, গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বিড়ম্বনা এবং ভর্তিতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আমরা এ ব্যবস্থা থেকে বের হতে চাই। সমন্বিত ভর্তি হতে হলে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আসতে হবে; কেউ আসবে কেউ আসবে না, তা হলে তো আর সমন্বিত হবে না। দ্বিতীয়ত, ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করার দাবি আমরা করেছি। ভর্তির ফি নিয়ে আমরা বলেছি তা কমিয়ে রাখার জন্য। যখন গুচ্ছ ছিল না তখন ৮শ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যেই ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়া শেষ হতো। কিন্তু এখন তা দুই হাজার টাকারও বেশি দিতে হচ্ছে। 

গুচ্ছ প্রক্রিয়াকে শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ ও লাভজনক করা যায়নি জানিয়ে অধ্যাপক ড. আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান বলেন, এটি শিক্ষার্থীদের জন্য এখন আরও বেশি হয়রানিমূলক হয়েছে। প্রথমে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর মাইগ্রেশনে আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দৌড়াতে হয়। এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ভর্তি সংক্রান্ত নানা জটিলতায় তা বাতিল করে আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। এমন নানা হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আমরা গুচ্ছ থেকে বের হতে চাই। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে তাদের ক্লাস শুরুর পর প্রথম বর্ষ শেষের দিকে আর আমরা এখনো ক্লাসই শুরু করতে পরিনি। এই যে একটি প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে শিক্ষার্থীদের একবছর সময় নষ্ট হলো তার দায় কে নেবে-এমন প্রশ্নও ছিল এই শিক্ষকের।

আরও পড়ুন: গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় যেতে চায় না ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন অব্যাহত রাখতে হলে একাডেমিক বিষয়গুলোতে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিয়ে নীতি-নির্ধারণ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন না থাকলে তো তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমরা গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য গতবছর ১০ দফা দাবি ছিল তার একটিও মানা হয়নি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি থেকে একমত হয়েছি এবং সামনে আমাদের একাডেমিক কাউন্সিলের সভা রয়েছে তাতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। তবে আমাদের শিক্ষক সমিতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬ টি বিভাগ এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় না থাকার বিষয়ে, আমরা এ রকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় থাকতে চাই না; সমন্বিত হলে এখানে সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে আসতে হবে।

গুচ্ছ ভর্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা এবং এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট, শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগসহ নানা অব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষক সমিতির শিক্ষকরা। এ নিয়ে তাদের পরিচালিত একটি জরিপে অংশ নেওয়া ৯৮ শতাংশ শিক্ষকই গুচ্ছে না থাকার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষকরা মোটা-দাগে ভর্তিতে দীর্ঘ-সময়ক্ষেপন, শিক্ষার্থীদের হয়রানি, সেশনজট, ফলাফল সংক্রান্ত জটিলতা এবং গুচ্ছ নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকাসহ বিবিধ নেতিবাচক বিষয়কে সামনে এনে এ মতামত দিয়েছেন।

এ নিয়ে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকিয়া সুলতানা মুক্তা মনে করেন যেহেতু গুচ্ছের চলমান সমস্যাগুলোর খুব বেশি উন্নতি হয়নি তাই গুচ্ছ নিয়ে শিক্ষকদের মনোভাব পরিবর্তন হয়নি। তিনি বলেন, আগামী মার্চে আমাদের একাডেমিক কাউন্সিলে এ বিষয়টি আলোচিত হবে। তখনই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। তিনি বলেন, একবছরে অবস্থার যেহেতু খুব বেশি উন্নতি হয়নি শিক্ষকরা তাদের পূর্বের মতামতই বহাল রাখবেন বলে মনে হচ্ছে।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. সালেহ আহম্মেদ গুচে্ছর চলমান নানা সমস্যার সমাধান হিসেবে মনে করেন, গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়াটি আরও পরিকল্পিত হওয়া উচিৎ। সেজন্য তিনি চলমান কৃষি গুচে্ছর মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আলাদা, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আলাদা ভর্তি প্রক্রিয়া বা পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। শিক্ষার্থীদের সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে বিষয় প্রদানের পাশাপাশি গুচে্ছর চলমান অব্যবস্থাপনার সমাধান হওয়া দরকার বলেও মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন: ভর্তিচ্ছুদের ভোগান্তি কমাতে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: আহ্বায়ক

গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক সমিতি। গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় নানা অব্যবস্থাপনা, শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি এবং সংকটের কারণে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. তপন কুমার জোদ্দার বলেন, গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় নানান অব্যবস্থাপনা ও সংকটের বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সভায় কার্যনির্বাহী সদস্যদের সকলেই নিজস্ব পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। খুব দ্রুতই বিষয়টি চিঠি আকারে উপাচার্যকে জানানো হবে। এছাড়া সভায় শিক্ষার্থী বান্ধব প্রক্রিয়ায় যত দ্রুত সম্ভব ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতে পরবর্তী অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সভায় সিন্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপাচার্যকে পত্র প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, দেশে বর্তমানে ৫৩টি সরকারি এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সবগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাবি, রাবি, চবি ও জাবি এবং কয়েকটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অধিকাংশই গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। যাতে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একজন শিক্ষার্থী একটি পরীক্ষা দিয়েই ভর্তি হতে পারেন। আর ১৯৭৩ সালের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ থাকে আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে।