ট্যুরের টাকার জন্য

মেডিকেল পড়ুয়া নাতনির পরিকল্পনায় নানাকে হত্যা

ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেন্টাল বিভাগের পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী আনিকা তাবাসসুম ও অতার ভাই স্থানীয় একটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বছর শেষে পরীক্ষার পর তারা কোথাও বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে যাবেন বলে পরিকল্পনা করেন‌‌। কিন্তু ঘুরতে যাওয়ার টাকা কোথায় থেকে আসবে সেই চিন্তা তাদের তাড়া করে। এক পর্যায়ে আনিকা তার নানা মনসুর আহমেদের বাসায় থাকা টাকা-পয়সা লুট করবেন বলে পরিকল্পনা করেন। এজন্য তার বয়ফ্রেন্ড রাজুকে পরিকল্পনার বিষয়টি শেয়ার করেন। সে মোতাবেক রাজু তার বন্ধুবান্ধবদের জোগাড় করেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা বাসা ফাঁকা হওয়ার অপেক্ষা করেন।

ঘটনার দিন বাসার সবাই একটি বিয়ের দাওয়াতে যান। তখন মনসুর আহমেদ একাই বাসায় ছিলেন। সুযোগ বুঝে আনিকার বন্ধুরা তার নানার বাসায় ডাকাতির জন্য যান এবং নানা বাধা দিলে তাকে হত্যা করে টাকা-পয়সা স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যান তারা।

রাজধানীর চকবাজারের বায়তুন নূর খাজে দেওয়ান মসজিদের সভাপতি মনসুর আহমেদ হত্যার ঘটনায় তদন্ত নেমে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ। এ ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী মেডিকেল পড়ুয়া শিক্ষার্থী আনিকা তাবাসসুমসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

আজ বুধবার (২৩ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপি যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব বিজয় বসাক। এর আগে মঙ্গলবার রাতে চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- নিহতের নাতি শাহাদাত মুবিন আলভী (২০), মেডিকেল পড়ুয়া নাতনি মূল পরিকল্পনাকারী আনিকা তাবাস্সুম (২৩), আনিকার বয়ফ্রেন্ড রাজু (২২), সহযোগী রায়হান (২০) ও সাঈদ (২০)।  

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আসলে এটি হচ্ছে একটি পারিবারিক বা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মতো একটি ঘটনা। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এর সঙ্গে নিহতের নাতি-নাতনি সরাসরি জড়িত। মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন নাতনি আনিকা। এর মধ্যে একজন মেডিকেল পড়ুয়া, আরেকজন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষ পড়ছেন।

বিপ্লব বিজয় বসাক বলেন, পরীক্ষা শেষে তারা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। সে কারণে তাদের টাকার প্রয়োজন হয়। তারা পরিকল্পনা করেন নানার কাছ থেকে টাকা নেবেন। এজন্য নিহতের নাতনি তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করেন। ঘটনার এক মাস আগে তারা ডাকাতির পরিকল্পনা করেন। মূল পরিকল্পনাকারী আনিকা তাবাসসুম ও তার বয়ফ্রেন্ড রাজু একটি ভালো সময় খুঁজতে থাকেন। এই কাজের জন্য আনিকার বয়ফ্রেন্ড রাজু তার ভাইসহ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে ভাড়ায় ঠিক করেন। ঘটনার আগে আনিকা বাসার নকল চাবি তৈরি করেন, যেটি পরে তাদের সরবরাহ করেন।

যেভাবে হত্যা করা হয়
পুলিশ জানায়, ঘটনার রাতে আনিকা তার বয়ফ্রেন্ড রাজুকে সেই বাসার চাবি দেন। পরিকল্পনা অনুযাযী বাসায় ঢুকে প্রথমে তারা সেই বয়স্ক ব্যক্তিকে ইঞ্জেকশন পুশ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি বাধা দিতে গেলে তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। তারা তাকে হাত-পা বেঁধে মারধর করেন। এরপর বাসায় যা যা ছিল তারা সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যান। ঘটনার সময় তারা স্বর্ণালংকারসহ ৯৩ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। 

পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এই ঘটনায় সিসি ক্যামেরা ফুটেজ এবং ডিজিটাল প্রমাণ পাওয়ার পর প্রথমে আনিকাকে পরে তার ভাই তালহাকে, সবশেষে রাজুকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা আরও কয়েকজনের নাম জানান। পরে বাকিদের গ্রেফতার করা হয়। তারা এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন এবং কীভাবে তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন তাও জানিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে তাদের চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনা সময় যারা ঘরের দরজা খুলে ইনজেকশন পুশ করেছিল এবং ওই বয়স্ক লোককে বেঁধে যারা মারধর করে চলে যায়, তাদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে।

একটি সিরিঞ্জ খুলে দিল ঘটনার জট
বিপ্লব বিজয় বসাক বলেন, ১৮ নভেম্বর রাতে পুলিশ খবর পেয়ে সেই বাসা থেকে লাশ উদ্ধার করে। পরে ঘটনাস্থল এবং লাশের চিত্র দেখে আমাদের সেটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে মনে হয়েছিল। সেই ঘরে একটি সিরিঞ্জ পাওয়া যায়। সেটি দেখে আমাদের সন্দেহ জাগে। তখন মনে হতে থাকে, ঘটনাটি হয়তো ভিন্ন ধরনের। প্রথমে আমরা ডাকাতির মামলা নিয়েছিলাম। কিন্তু তদন্তে নেমে ঘটনা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। তখন আমরা সন্দেহ করি, এই ঘটনায় পরিবারের কেউ জড়িত থাকতে পারে। তদন্ত করতে নেমে আরও জানতে পারলাম, এই ঘটনায় তার খুব কাছের লোকজন জড়িত।