ইরানে হিজাব বিক্ষোভের নেপথ্যে যা রয়েছে 

ইরান
ইরানে দেশজুড়ে আবার বিক্ষোভের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে

ইরানে দেশজুড়ে আবার বিক্ষোভের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে পুলিশি হেফাজতে এক তরুণীর মৃত্যুর প্রতিবাদে । প্রায় এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং প্রাণঘাতী এ বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। ইতোমধ্যে ৪১ জন নিহত হয়েছেন সপ্তাহখানেকের বিক্ষোভ-সহিংসতায়।বিক্ষোভকারীরা পুলিশের গাড়ি ও রাষ্ট্রীয় ভবনে অগ্নিসংযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা এবং 'স্বৈরশাসকের মৃত্যু' বলে স্লোগান দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ৪১ জন মারা গেছেন, যাঁদের বেশিরভাগই বিক্ষোভকারী। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। খবর দ্য গার্ডিয়ান ও এএফপির।

সঠিকভাবে হিজাব না পরায় ধর্মীয় পুলিশের হেফাজতে মাহসা আমিনি নামের এক তরুণীর মৃত্যুর পর ক্ষোভ ফেটে পড়ে দেশটিতে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ আন্দোলন আসলে হিজাবের বিরুদ্ধে নয়। দেশটির রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অচলাবস্থার বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটছে এ বিক্ষোভে।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর কুর্দি তরুণী মাহসার মৃত্যুর পর এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ইরানে।  মাহসার পোশাক ইসলামী রীতি অনুযায়ী অনুপযুক্ত ছিল দাবি করে তাঁকে একটি ভ্যানে করে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যায় দেশটির ‘নৈতিকতা পুলিশ’। তিন দিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশি হেফাজতে তিনি মারা যান।

আরও পড়ুন: সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাস ছাড়া ছাত্রলীগের রিভা-রাজিয়া, আনন্দ মিছিল

কর্তৃপক্ষের দাবি, তার ওপর সহিংসতা চালানো হয়নি। তিনি আগে থেকেই শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। পুলিশ হেফাজতে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। তবে অনেক ইরানির কাছে এটা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।

মাহসার মৃত্যু নাগরিকদের এতটাই নাড়া দিয়েছে যে, ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল ইরানিরাও এর বিরুদ্ধে কথা বলছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় হিজাব পরা নারীরাও তার পক্ষে সংহতি জানাচ্ছেন। দেশটির একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতা বলেছেন, নৈতিক পুলিশ শুধু তরুণীদের ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এমনকি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমও এই সমস্যাটিকে স্বীকার করে অন্তত তিনটি বিতর্ক সম্প্রচার করেছে, যা বিরল ঘটনা।

গত ৯ দিনে বিক্ষোভ অন্তত ৮০টি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভকারীরা 'নারী, জীবন এবং স্বাধীনতা' বলে স্লোগান দিচ্ছেন। তাঁরা দেশটির অসুস্থ সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে লক্ষ্য করে 'স্বৈরশাসকের মৃত্যু' বলে স্লোগান দিচ্ছেন। অনেক নারী তাঁদের মাথার স্কার্ফ ছিঁড়ে ফেলছেন এবং কুম ও মাশহাদের মতো গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ মানুষের শহরেও আগুন দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একটি গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে একজন তরুণী তার চুল কেটে ফেলছেন।

অন্যটিতে দেখা যায়, তরুণীরা দাঙ্গা পুলিশের সামনে খালি মাথায় নাচছে। দেশের মধ্যে এবং বাইরের বেশ অনেক ইরানি সেলিব্রিটি বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছেন। তবে কঠোরভাবে রক্ষণশীল দেশটিতে হিজাবের পক্ষে নারীরাও শোডাউন করেছেন। বিক্ষোভ দমনে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইনস্টাগ্রামের মতো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত মেসেজিং অ্যাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ইরানিদের একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা বহির্বিশ্বের সঙ্গে ঘটনার আপডেট শেয়ার করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর প্রথমবারের মতো এ বিক্ষোভে ধনীদের পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণিও যোগ দিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের এই ধরনের ঝুঁকি নেওয়ার কারণ হলো তারা মনে করে যে, তাদের হারানোর কিছু নেই। বিদ্যমান ব্যবস্থায় তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই বিক্ষোভ এখন ইরানের নিয়মিত বৈশিষ্ট্য। আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানের পরিচালক আলী ওয়ায়েজ বলেন, সংস্কারকে ক্রমাগত অস্বীকার করে দেশের নেতৃত্ব এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে লোকেরা আর বিশ্বাস করে না যে, এ ব্যবস্থা সংস্কারযোগ্য। 

দুই দশক ধরে ইরানের নারী অধিকারের পক্ষে প্রচারণা চালানো বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজীবী শাদি সদর বলেন, শুধু মাহসার মৃত্যু ক্ষোভের কারণ নয়। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, 'যথেষ্ট হয়েছে। সম্মানজনক জীবন পেতে আমি মরতেও রাজি।' ইরানি নেতৃত্বও কঠোরভাবে বিক্ষোভ দমন করছে। বোস্টনের ইরানি বংশোদ্ভূত সমাজবিজ্ঞানী মোহাম্মদ আলী কাদিভার বলেছেন, দেশটির শীর্ষ নেতারা সর্বদা বলেছেন, আমরা ছাড় দেব না। কারণ আমরা যদি একটি ছোট ছাড় দিই, তবে আমাদের আরও বড় ছাড় দিতে হবে।

প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি শনিবার 'দেশের নিরাপত্তা ও শান্তির বিরোধিতাকারীদের' দমন করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। রোববার দেশটির বিচার বিভাগীয় প্রধান গোলামহোসেন মোহসেনী এজেইও বলেছেন, কুর্দি তরুণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের কোনো ক্ষমা হবে না।