কৃষি ও কৃষকের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করবে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

ভাইস চ্যান্সেলর
প্রফেসর ড. এ. কে. এম. জাকির হোসেন এবং কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো

কুড়িগ্রাম জেলা বাংলাদেশে পিছিয়ে পড়া জনপদগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ৭০.৮ শতাংশ দরিদ্র মানুষ নিয়ে দেশে দারিদ্র্যের শীর্ষে অবস্থান করছে কুড়িগ্রাম। এক সময়ের মঙ্গাপীড়িত এই জেলাটির ‘মঙ্গা কলঙ্ক’ ঘুচে গেলেও দারিদ্র এখনও কাটেনি। স্বাধীনতার পরও প্রায় প্রতি বছরই মঙ্গাপীড়িত হয়ে এক বেলা, আধবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে এই জেলার অসংখ্য মানুষকে। তবে বর্তমান সরকারের নানামুখী প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের ফলে বিগত এক দশকে এই জেলার আর্থ সামাজিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তারপরও দারিদ্র্যের সঙ্গে কুড়িগ্রামবাসীর লড়াই এখনও থামেনি। নদী ভাঙ্গন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও উচ্চ শিক্ষার কোন বিদ্যাপীঠ গড়ে না উঠাকেই এ অঞ্চলের মানুষজন অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করে।

ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত সীমান্তবর্তী এবং বৃহৎ নদ-নদী যুক্ত জেলা কুড়িগ্রাম। এর আয়তন প্রায় ২২৫৫.২৯ বর্গকিলোমিটার আর জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৪ লাখ। এই জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে সাতটি উপজেলার সঙ্গে ভারতের তিন রাজ্যের সীমান্ত প্রায় ২৭৮.২৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ৩২ কিলোমিটার সীমানাজুড়ে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই। জেলা সদরের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে রৌমারী এবং ৩টি ইউনিয়ন নিয়ে চর রাজিবপুর উপজেলা গঠিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, চর রাজিবপুরই দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম উপজেলা। এই উপজেলার প্রায় ৭৯.৮ ভাগ মানুষই হতদরিদ্র। এমনকি কুড়িগ্রামের সবচেয়ে কম দরিদ্র ফুলবাড়ি উপজেলায়ও ৬৯ ভাগ মানুষ হতদরিদ্র জীবন-যাপন করে।

জেলায় কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান না থাকায় এখানকার প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে এই জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ভারত অংশে বাঁধ দেয়ার কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চর পড়েছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলে প্রচন্ড খরা দেখা দেয়। নদীটির নাব্যতা না থাকায় বর্ষা মৌসুমে বন্যা দেখা দেয়। এছাড়াও প্রচন্ড শীতল আবহাওয়াসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলাতে হয় এই জনপদকে। অন্যান্য জেলার তুলনায় কুড়িগ্রামে এখনও যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ না থাকায় এলাকার মানুষ আর্থ সামাজিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অনেকটাই অনগ্রসর।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি কৃষি। দেশে কৃষিব্যবস্থার আধুনিকায়ন তথা বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন ও কৃষিবিজ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্বমানের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কুড়িগ্রামের পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত করার লক্ষ্যে কুড়িগ্রাম জেলাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে এক জনসমাবেশে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে এ এলাকায় মঙ্গা থাকবে না। এ শব্দ মানুষ ভুলে যাবে। এ কুড়িগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করে দেব। কুড়িগ্রামে কৃষি উৎপাদনে আমরা ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। নদীগুলো আমরা ড্রেজিং করে দেব। সেইসঙ্গে এখানে শিল্প-কলকারখানা যাতে গড়ে ওঠে এর জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলবো।’

কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে মানুষের আর্থসামাজিক এবং কৃষির উন্নয়নে দেয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। যুগোপযোগী ও চাহিদাভিত্তিক পঠন-পাঠন-গবেষণায় কৃষিনির্ভর পশ্চাৎপদ কুড়িগ্রামের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। কুড়িগ্রামের মানুষের প্রত্যাশা পুরণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশতবার্ষিকীতে কুড়িগ্রামবাসীর জন্য উপহার হিসেবে মহান জাতীয় সংসদে ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করা হয়। সেই হিসেবে আজ ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার এক বছর পূর্তি হচ্ছে। পরবর্তীতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গত ২৬ এপ্রিল ২০২২ তারিখে আমাকে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এবং ৮ই মে ২০২২ তারিখে আমি উপাচার্য হিসেবে যোগদান করি। প্রথম উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির এক বছর পূর্তির এই শুভক্ষণে শুভানুধ্যায়ীসহ সকলকে জানাচ্ছি আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এ অঞ্চলের অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিরলস পরিশ্রম ছিল। আমি তাঁদের সকলের এই অসামান্য অবদানকে আজকের এই দিনে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।

বৈশ্বিক নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রযুক্তি সমৃদ্ধ স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিচিতি তুলে ধরে শিক্ষা, গবেষণা, কৃষি, তথ্য ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে একটি মনোগ্রাম তৈরিসহ এর ব্যবহার সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরির কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। কুড়িগ্রাম জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে স্থান নির্ধারণের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ (২০২২-২০২৩) থেকে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্যে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিধি-বিধান, নীতিমালা প্রণয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী অনুষদ, শিক্ষা বিভাগ, ডিগ্রীর নামাকরণসহ বিভিন্ন ইনস্টিটিউট, ফার্ম, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অফিস স্থাপনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে।

শিক্ষার গুণগত মান ও পরিবেশ উন্নয়ন এবং গবেষণার পরিধি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ‘একাডেমিক মাস্টার প্লান’ও প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার ক্ষেত্র জোরদার করার জন্য ‘ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া’ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা যাতে ভালো গবেষণা করে নতুন নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এ অঞ্চলের কৃষির উন্নয়ন তথা উৎপাদন, বাণিজ্য ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় সেদিক বিবেচনা আধুনিক কোর্স কারিকুলা প্রণয়ন করা হচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড বিজনেস কমিউনিকেশন, রিনিউঅ্যাবল এনার্জি অ্যান্ড গ্রিন টেকনোলজি, জিওইনফরমেটিকস অ্যান্ড ন্যানোটেকনোলজি, ফুড সেফটিসহ বিভিন্ন বিষয় সংযুক্ত করা হচ্ছে, যাতে শিক্ষার্থীদের কৃষির রূপান্তরগুলো যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারে। শিক্ষার্থীদেরকে প্রথম থেকেই এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি অ্যাটাচমেন্ট, ফারমার ফিল্ড অ্যাটাচমেন্ট, প্রজেক্ট ওয়ার্ক ও ইন্টার্নশিপে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে অসাম্প্র দায়িক, প্রগতিশীল ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা একান্তভাবে প্রত্যাশা করছি।

লেখক: উপাচার্য, কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।