বিশ্ববাজারে কমেছে তেলের দাম, দেশে কেন আগুন?
বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম আরও কমেছে। গত বৃহস্পতিবার ব্রেন্ট ক্রুড প্রতি ব্যারেল ৯৩ দশমিক ৮১ ডলারে নেমে আসে, যা গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলার পর সর্বনিম্ন। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় কিছুদিন আগে ডিজেলের দাম কমেছে এশিয়ার সংকটপূর্ণ দেশ শ্রীলঙ্কাও। এদিকে সব কিছু উপেক্ষা করে দেশের জ্বালানি বাজারে যেন জ্বলছে আগুন। গত শুক্রবার থেকে দেয়া সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, বাংলাদেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম রাতারাতি ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই দাম বৃদ্ধির হার প্রায় ৪২ শতাংশ। লিটার প্রতি পেট্রলের দাম ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা করা হয়েছে। অকটেনের দাম বেড়েছে ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা। অর্থাৎ পেট্রল ও অকটেনের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশেরও বেশি।
এখন জনমনে প্রশ্ন, সরকার আন্তজার্তিক বাজারকে দুষছে কিন্তু সেখানে দাম কমার পরও কেন দেশে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে সকল ধরনের জ্বালানি তেলের দাম।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমা সত্ত্বেও কেন আমরা সে পরিমাণ সুবিধা ভোগ করতে পারছি না? এ বিষয়ে আমদানিকারকরা দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন-এক. বিশ্ববাজারে পড়তি দামের পণ্য এখনো দেশে না আসা; দুই. ডলারের দাম স্থানীয়ভাবে বেড়ে যাওয়া।
দেখা গেছে, বিশ্ববাজারে শনিবার দাম কমে গেলে রোববারেই সেই পণ্য স্থানীয় বাজারে আসবে না; পণ্য পরিবহণে কিছুটা সময় লাগবে। তাই দাম অপরিবর্তিত থাকার পেছনে যুক্তি আছে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম দেখা যায় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলে। অর্থাৎ, যখন বিশ্ববাজারে শনিবার কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, তখন রোববারেই কেন পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হলো ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধি করা। প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম যতই বাড়ুক বা কমুক, আমরা ন্যায্যমূল্যের অনেক বেশি দাম পরিশোধ করি। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমাদের আমদানি বাজারে প্রতিযোগিতা কম হওয়ায় আমরা প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এর পাশাপাশি বাজার মনিটরিংয়েও দুর্বলতা প্রকট।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুফল না পাওয়ার দ্বিতীয় কারণ হিসাবে টাকার অবনমন বা ডলারের দামবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এ কথা অনেকাংশে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। গত মে মাসের শেষের দিকে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা। এরপর থেকে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। বর্তমানে ব্যাংকে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। খোলাবাজারে ডলারের দাম উঠেছে ১১০ টাকায়। আমদানিকারকরা বলছেন, তাদেরকে এখন ঋণপত্র বা এলসি খুলতে ডলারপ্রতি ব্যয় করতে হচ্ছে ১০৫ টাকা। তাহলে দেখা যায়, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। বিশ্ববাজার থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করতে এখন জাহাজভাড়াসহ টনপ্রতি খরচ পড়ছে ১ হাজার ৪০০ ডলার। মে মাসের ডলারপ্রতি ৮৬ টাকা ধরলে এক লিটার তেলের দাম হতো ১২০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে ডলারপ্রতি ১০৫ টাকা ধরলে লিটারপ্রতি দাম হয় ১৪৭ টাকা। কেবল ডলারের দাম বাড়ার কারণে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ২৭ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে।
এদিকে তথ্য মতে, বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের মজুত সক্ষমতা মাত্র ১৩ লাখ টন। এ কারণে আমাদের প্রতিনিয়তই জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। সবচেয়ে বেশি মজুত সক্ষমতা রয়েছে ইস্টর্ন রিফাইনারির। প্রতিষ্ঠানটি ৫ লাখ ২ হাজার ২৯০ টন জ্বালানি মজুত করার সক্ষমতা রাখে। এর বাইরে বিপণনকারী সংস্থা পদ্মা অয়েলের চট্টগ্রামের প্রধান ডিপোয় মজুত সক্ষমতা ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৭৩ টন, মোংলায় ৩৫ হাজার টন, গোদনাইলে ৩০ হাজার ৯৩৪ টন। যমুনা অয়েলের চট্টগ্রামে ৮২ হাজার ২৪০ টন, মোংলায় ২৯ হাজার ৬৩০ টন জ্বালানি তেল মজুত সক্ষমতা রয়েছে। মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মজুত সক্ষমতা চট্টগ্রাম ডিপোতে ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৭৪ টন, মোংলায় ২৭ হাজার ৯৭২ টন। এর বাইরে বিপিসির অধীন স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল লিমিটেডের ধারণসক্ষমতা ৩৩ হাজার ৬২৫ টন।
আমাদের জ্বালানি তেল সংরক্ষণ করার যে সক্ষমতা, তা দিয়ে ৪৫ দিনের জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আমদানিনির্ভর দেশগুলোর ধারণ-সক্ষমতার আন্তর্জাতিক প্রমিত মান হলো ৯০ দিনের। সেই অর্থে আমাদের সক্ষমতা অর্ধেক। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে আমরা তা অধিক হারে আমদানি করে মজুত করতে পারি না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের এ সক্ষমতা বৃদ্ধি হলেই কেবল কম দামের সুফল ভোগ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
আমদানিকারকদের কারসাজি, ডলারের দামবৃদ্ধি, আর আমাদের মজুত করার অক্ষমতার পরিণাম ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মোকাবিলায় হাঁপিয়ে উঠছে জনগণ।