যেভাবে এলো কোরবানি
রাত পোহালেই দেশে উদযাপিত হবে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহৎ উৎসব ঈদুল আজহা। আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য এইদিনে সামর্থ্যবান মুসলিমরা নিজেদের সামার্থ অনুযায়ী পশু কোরবানি করে থাকেন যার একটি নির্দিষ্ট অংশ বিতরণ করতে হয় গরীবদের মাঝে।
ইসলামে এই কোরবানির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। পবিত্র আল কুরআনের বর্ণনামতে, হাবিল প্রথম মানুষ হিসেবে আল্লাহর জন্য একটি পশু কুুরবানী করেন। সূরা মায়েদার ২৭নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে নবী! কিতাবিগণকে আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের ঘটনা ভালো করে বর্ণনা করো। তারা যখন কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো। কিন্তু অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। ক্ষিপ্ত হয়ে সে বলল, আমি তোমাকে খুন করবো। অপরজন বলল, প্রভু তো শুধু আল্লাহ-সচেতনদের কোরবানিই কবুল করেন।’
এ প্রসঙ্গে সাহাবা ইবনে কাসির বর্ণনা করেছেন যে, ‘হাবিল একটি ভেড়া এবং তার ভাই কাবিল তার ফসলের কিছু অংশ স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে। আল্লাহর নির্ধারিত পদ্ধতি ছিল যে আগুন আকাশ থেকে নেমে আসবে এবং গ্রহণযোগ্য কুরবানী গ্রহণ করবে। তদনুসারে, আগুন নেমে আসে এবং হাবিলের জবেহকৃত পশুটির কুরবানী গ্রহণ করে।
অন্যদিকে কাবিলের ফসল কুরবানী প্রত্যাখ্যান করে। কাবিল এই ঘটনায় ঈর্ষান্বিত হয় ও সামাজিভাবে অপমানবোধ করে কুরবানী কবুল না হওয়ার বিষয়টি তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে, যা মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যাকাণ্ড হিসেবে পরিচিত। কাবিল তার কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হওয়ায় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেননি।’
আরও পড়ুন: ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে দেবে ৮ কাজ
সূরা হজ-এর ৩৪ এবং ৩৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যে কোরবানিকে ইবাদতের অংশ করেছি। যাতে জীবনোপকরণ হিসেবে যে গবাদি পশু তাদেরকে দেয়া হয়েছে, তা জবাই করার সময় তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে আর সব সময় যেন মনে রাখে একমাত্র আল্লাহই তাদের উপাস্য। অতএব তাঁর কাছেই পুরোপুরি সমর্পিত হও। আর সুসংবাদ দাও সমর্পিত বিনয়াবনতদের, আল্লাহর নাম নেয়া হলেই যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, যারা বিপদে ধৈর্যধারণ করে, নামাজ কায়েম করে আর আমার প্রদত্ত জীবনোপকরণ থেকে দান করে।’
তবে বর্তমানে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা জিলহজ্জ মাসের যেই দিনে ঈদুল আজহা উদযাপন করে সেটি হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সময় থেকে আল্লাহর নির্দেশে পালন করা শুরু হয়।
সূরা সাফফাতের ১০২নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ছেলে যখন পিতার কাজকর্মে অংশগ্রহণ করার মতো বড় হলো, তখন ইব্রাহিম একদিন তাকে বলল, ‘হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে কোরবানি দিতে হবে। এখন বলো, এ ব্যাপারে তোমার মত কী? ইসমাইল জবাবে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। ইনশাল্লাহ! আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে বিপদে ধৈর্যশীলদের একজন হিসেবেই পাবেন।’
ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী, আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে এবং নিজ পুত্র হজরত ইসমাইলের সম্মতিতে হজরত ইবরাহিম পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে তাকে নিয়ে মিনার একটি নির্জন স্থানে যান এবং তার চোখ বেঁধে মাটিতে শুইয়ে দেন। অতঃপর কোরবানি করার জন্য পুত্রের গলায় ছুরি চালান।
পরবর্তীতে চোখ খুলে দেখতে পান হজরত ইসমাইল (আ.) তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তার পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়েছে। এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি ঈদ উল আজহা হিসেবে উদ্যাপন করে।
এ প্রসঙ্গে সূরা সাফফাতের ১০৬-১০৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মনে রেখো, এ ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে সুযোগ দিলাম এক মহান কোরবানির। পুরো বিষয়টি স্মরণীয় করে রাখলাম প্রজন্মের পর প্রজন্মে। ইব্রাহিমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎকর্র্মশীলদের পুরস্কৃত করি।’
কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, পবিত্র এই দিনে কোরবানির রয়েছে অপরিসীম ফজিলত। সূরা হজের ৩৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, কোরবানির পশুকে আল্লাহ তাঁর মহিমার প্রতীক করেছেন। তোমাদের জন্যে এতে রয়েছে বিপুল কল্যাণ। অতএব এগুলোকে সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় এদের জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। এরপর এরা যখন জমিনে লুটিয়ে পড়ে, তখন তা থেকে মাংস সংগ্রহ করে তোমরা খাও এবং কেউ চাক না চাক সবাইকে খাওয়াও। এভাবেই আমি গবাদি পশুগুলোকে তোমাদের প্রয়োজনের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় করো।’
এছাড়া, সূরা কাওসারের ২ এবং ৩নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের জন্যেই নামাজ পড় ও কোরবানি দাও। নিশ্চয়ই তোমার প্রতি যেই বিদ্বেষ পোষণ করবে, বিলুপ্ত হবে ওর বংশধারা।’